Saturday, October 31, 2020

সত্যজিৎ ১০০ (১)

#সত্যজিৎ_১০০ (১)

গপ্পো। ডেভিড ও. সেলজেনিক। আমেরিকান প্রডিউসার। গন উইদ দ্য উইন্ড, রেবেকা, স্পেলবাউন্ড। বদভ্যাস। ডিরেক্টরদের নোট পাঠান যখনতখন, তাদের কাজ এর দিকনির্দেশ করে। পথের পাঁচালির জাদুতে বিমোহিত হয়ে সত্যজিৎ-কে ডেকে পাঠালেন বার্গম্যান এর হাতে পুরস্কার তুলে দেবার অছিলায়, আসল উদ্দেশ্য পরিচালকের সাথে কাজ করার। ওদিকে এই বিষয়ে রায়বাবুর মানসিকতা তাঁর শুরুর জীবনে প্রভাববিস্তার করা জঁ রেনোয়ার কাছাকাছি। স্বতঃস্ফূর্ততার বিপরীতে হেঁটে, হলিউডের ছবিতে আলো-শব্দ থেকে শুরু করে পরিচালক এর দক্ষতা অব্দি একাধিকবার যাচাই করে নেবার প্রথার তীব্র বিরোধী তিনি। সেলজেনিক এর প্রস্তাব এল অচিরেই, সত্যজিৎ জানালেন তার অপছন্দ। সেলজেনিক বললেন তিনি সত্যজিৎ এর খাতিরে ভুলে যেতে চান তার অভ্যাস। সেক্ষেত্রে তিনিও রাজি, জানান সত্যজিৎ।

পুরস্কারপ্রদানের রাত্রের সন্ধ্যায় সত্যজিৎ হোটেলের ঘরে ঢুকেই দেখেন সেলজেনিকের নোট। পুরস্কার দেবার সময় ছ-সাতমিনিট কি বলতে হবে তার নির্দেশ, না বদলানোই ভালো ঠারেঠোরে এটা বুঝিয়ে দেবার সাথে।

সত্যজিৎ নিজের কথাই বললেন।

অবশ্যম্ভাবী, যুগ্ম উদ্যোগটাও অঙ্কুরে বিনষ্ট হলো।

---------------

বই: অদ্বিতীয় সত্যজিৎ
লেখক: মঞ্জিল সেন (সম্পাদনা ও টীকা: স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায়)
প্রকাশক: বুকফার্ম (ই বুক আছে, সুইফটবুকস য়্যাপে পড়েছি আমি)
খুব ভালো: বংশপরিচয় ও ছোটবেলার গল্প, সহজ গদ্য, সমস্তকিছু ছুঁয়ে যাওয়া।
আর একটু ভালো হতে পারতো: দেবতা বানাবার চেষ্টা না করা (রবীন্দ্রনাথ 'ঠাকুর' হয়ে রিডিংলিস্ট থেকে অন্তর্হিত হয়েছেন), জাম্প কাটের মত বিষয় পরিবর্তন এড়ানো।

Saturday, August 29, 2020

মারিও দি আন্দ্রেদ এর কবিতা

(সকালবেলায় প্রিয় চিত্রপরিচালক অতনু ঘোষ এর ফেসবুক দেওয়ালে মারিও দি আন্দ্রেদ নামে এক ব্রাজিলিয়ান কবি'র লেখা এই কবিতাটা দেখেছিলাম। এটা তার অক্ষম গদ্য ভাবানুবাদ)

~

বছর ঘুরতে ঘুরতে যখন হিসেব কষতে বসলাম
আর দেখলাম বেঁচে থাকার জন্য সামান্য কিছু সময়ই হাতে আছে
অন্ততঃ যে সময় পেছনে পেছনে ফেলে এসেছি তার সাথে তুলনা করলে।

নিজেকে সেই ছেলেটার মত লাগলো যে একটা চকলেটের বাক্স হাতে পেয়েছিলো
শুরুতে সে সেগুলো একটার পর একটা মুখে ভরছিলো খুশিতে
তারপর যখন তার খেয়াল গেলো শেষ হয়ে আসা বাক্সটার দিকে
তখন সে তাড়াহুড়ো ভুলে একটা একটা'র স্বাদ তারিয়ে তারিয়ে নিতে শুরু করল।

এই মুহূর্তে অনিচ্ছায় সময় দিতে হচ্ছে অগণিত মেলামেশাকে, 
যেখানে কেবল নিয়ম, পদ্ধতি, আইন-ই আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে
কোনো কিছুই বাস্তবে পাওয়া যাবে না তা জেনেও।

ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলেছি সেই মানুষগুলোর জন্য
যারা তাদের বয়সের সাথে সমানুপাতে বেড়ে ওঠে নি।

আমার সময় খুবই অল্প
তাই খুব কম সময়ে পেতে চাইছি জীবনের সারবস্তুগুলোকে
আমার বাক্সে আর সামান্য কটা চকলেট পড়ে আছে।

এইসময় সেই লোকগুলোকেই পাশে পেতে ইচ্ছা করে
যারা তাদের ভুলগুলোকে অট্টহাস্যে জোর গলায় স্বীকার করে নিতে পারে
যারা তাদের কৃতিত্বের হাওয়ায় ফুলে ফেঁপে ওঠে না
যারা তাদের প্রত্যেকটা কাজের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নেয়
অর্থাৎ যে সমস্ত লোকেরা সভ্যসমাজ এবং তার অস্তিত্ব সত্য ও সততার সাথে আজও বজায় রেখেছে।

কেবলমাত্র অত্যাবশ্যক জিনিসই জীবনকে সমৃদ্ধ করতে পারে
কাজেই আমি শুধুমাত্র তাদের সাথেই বাকি সময়টা কাটাতে চাই
যারা তাদের সুন্দর হৃদয় দিয়ে তাদের হৃদয় স্পর্শ করতে পারবে যারা অপেক্ষাকৃত কঠোর জীবনপর্বে বেড়ে উঠেছে।

হ্যাঁ, আমি খুব তাড়াহুড়োয় আছি
আমি তাড়াহুড়োয় আছি জীবনকে সেই গভীরতায় বাঁচবার জন্য যা কেবলমাত্র এই অভিজ্ঞ বয়স আমাকে দিতে পারে
আমার চকলেটের বাক্সের শেষ কয়েকটা চকলেটকে আমি হেলাফেলায় শেষ করতে চাই না।

এই শেষ চকলেটগুলোর স্বাদ হবে অবর্ণনীয়
যেগুলো শেষ করে ফেলেছি তার থেকে অনেক বেশি আকর্ষণীয়
আমি আমার শেষের সময়ে একটা পরিষ্কার বিবেকের সাথে শান্তি আর পরিতুষ্টি নিয়ে পৌঁছাতে চাই।

আমাদের দুটো জীবন
আর দ্বিতীয়টা ঠিক তখন শুরু হয় যেদিন আমরা জানতে পারি আসলে জীবন একটাই।

Friday, August 28, 2020

সব ইয়াদ রাখখা জায়গা / আমির আজিজ

(অক্ষম ভাবানুবাদ, পৃথিবীর সমস্ত ফ্যাসিস্ট শাসকদের জন্য)

~

তুমি যখন বলবে রাত, আমি লিখবো চাঁদ
তুমি কারাপ্রাচীরের মধ্যে ঠেলবে, 
আমি তার কাঁটাতারওয়ালা দেওয়ালে বিচার লিখবো
তোমার সাজানো এফ আই আর এর জবাবে, আমি গাইবো 'আমরা করবো জয়'
তুমি খুন করবে আর আমি তার প্রমাণ লিখে যাবো দেওয়ালে দেওয়ালে।

তুমি আদালতকে বন্ধু বানিয়ে হাসিঠাট্টা করবে আমাকে নিয়ে
আমরা পথে ঘাটে দেওয়ালে বিধাতার রায় লিখবো
বধিরের কানে পৌঁছে যাওয়া পর্যন্ত ইনসাফ এর আওয়াজ তুলবো।

আমাদের লেখায় সত্যের ছটা অন্ধের চোখেও আলো এনে দেবে
তোমার কালো পদ্মের জবাবে আমরা লাল গোলাপ ফোটাবো
তুমি যতই আমার জমিতে অত্যাচার এর ফসল বুনবে
আমার আকাশ আমরা বিপ্লব এর কবিতায় ভরে দেব।

সব মনে রাখবো আমরা, সমস্ত কিছু মনে রাখবো আমরা
তোমাদের লাঠির আঘাতে বা বন্দুকের নলে
আমাদের যে বন্ধুরা চিরকালের জন্য হারিয়ে গেছে
তাদের স্মৃতি আমাদের ভাঙা হৃদয় এ যত্নে রেখে দেব আমরা।

সব মনে রাখবো আমরা, সমস্ত কিছু মনে রাখবো আমরা
তোমরা যখন ছাপার কালিতে মিথ্যের ইতিহাস লিখবে
আমরা তখন আমাদের রক্তের লেখায় ভবিষ্যৎকে একদিন সত্যি শোনাবার জন্য তৈরি হব।

সব মনে রাখবো আমরা, সমস্ত কিছু মনে রাখবো আমরা।

আমাদের মোবাইল টেলিফোন ইন্টারনেট বন্ধ করে
অন্ধকার সময়ে সারা শহরকে নজরবন্দি করে
আমার ছোট্ট ঘরে মারণ হাতিয়ার নিয়ে ঢুকে আসবে যখন আমার জীবনকে শেষ করতে
আমার সন্তানকে ঘিরে মাঝরাস্তায় মারণলীলা চালিয়ে
যখন মুচকি হেসে তুমি আমায় উদ্ধার করতে হাত বাড়িয়ে দেবে
তখন সব মনে রাখবো আমরা, সমস্ত কিছু মনে রাখবো আমরা।

দিনের বেলা যখন মিষ্টি কথায় আমাদের ভোলাবে
যখন ঝুটো বাগ্মিতার জাদুতে বোঝাবে সবকিছু ঠিক চলছে
অথচ রাতের অন্ধকারে প্রতিবাদীর গায়ে তুলবে লাঠি
আমার ওপর গুলি চালিয়ে আমাকেই বানাবে সন্ত্রাসবাদী
তখন সব মনে রাখবো আমরা, সমস্ত কিছু মনে রাখবো আমরা।

আমার অস্থিমজ্জায় লিখে রাখবো আমি এই হানাদারির কাহিনী
যখন তুমি আমার পরিচয় এর নথি চাইবে
আমি আমার অস্তিত্বর প্রমাণ অবশ্যই রেখে যাব
এই যুদ্ধ চলবে আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত্য
সমস্ত কিছু মনে রাখবো আমরা।

একথাও মনে রাখা হবে কেমনভাবে তুমি ভাঙতে চেয়েছিলে আমার প্রাণাধিক প্রিয় দেশ
আমাদের দেশকে জুড়ে রাখবার লড়াই মনে রাখবো আমরা
যখনই কাপুরুষতার প্রসঙ্গ উঠবে ভবিষ্যতে, তোমাদের উদাহরণ মনে রাখবো আমরা।

আর যখনই কথা উঠবে জীবনের
আমাদের নাম উচ্চারিত হবে চিরদিন
যাদের মজবুত মনকে বিভেদের হাতুড়ি দিয়েও ভাঙা যায় নি
যাদের বিবেককে তোমাদের মতো পয়সা দিয়েও কেনা যায় নি।

কিছু লোক যারা ঝড়ের মুখেও মাথা নোয়ায় নি
কিছু লোক যারা মারা যাওয়া পর্যন্ত জীবন্মৃতের পর্যায়ে গণ্য হয়নি।

তোমার চোখ হয়তো পলক ফেলতে ভুলতে পারে
পৃথিবীও হঠাৎ আহ্নিকগতি ভুলে দাঁড়িয়ে পড়তে পারে তার অক্ষে
কিন্তু আমাদের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেবার এই প্রচেষ্টা
আমাদের প্রতিবাদী কন্ঠস্বর-কে দাবিয়ে রাখবার এই ষড়যন্ত্র
সমস্ত কিছু মনে রাখবো আমরা।

তুমি যখন বলবে রাত, আমি লিখবো চাঁদ
তুমি কারাপ্রাচীরের মধ্যে ঠেলবে, আমি তার কাঁটাতারওয়ালা দেওয়ালে বিচার লিখবো
তোমার সাজানো এফ আই আর এর জবাবে, আমি গাইবো 'আমরা করবো জয়'
তুমি খুন করবে আর আমি তার প্রমাণ লিখে যাবো দেওয়ালে দেওয়ালে।

তোমার আঘাতে মৃত্যুর পর আমার আত্মা লিখবে
তোমার হননের সমস্ত প্রমাণ লিখবে
তুমি আদালতকে বন্ধু বানিয়ে হাসিঠাট্টা করবে আমাকে নিয়ে
আমরা পথে ঘাটে দেওয়ালে বিধাতার রায় লিখবো
বধিরের কানে পৌঁছে যাওয়া পর্যন্ত ইনসাফ এর আওয়াজ তুলবো।

তোমার কালো পদ্মের জবাবে আমরা লাল গোলাপ ফোটাবো
তুমি যতই আমার জমিতে অত্যাচার এর গদ্য লিখবে
আমরা আকাশ বিপলব এর কবিতায় ভরে দেব
আমাদের লেখায় সত্যের ছটা অন্ধের চোখেও আলো এনে দেবে।

যাতে তোমাদের নামে ঘৃণার নামকরণ হয় ভবিষ্যতে
যাতে তোমাদের নামে কালো কালিতে লেখা হয় ইতিহাস
তোমাদের নাম, তোমাদের কীর্তি, কিছুই ভোলা হবে না
সমস্ত কিছু মনে রাখা হবে।

😶

Tuesday, May 19, 2020

ভবেশবাবুর ভুল

করোনা-সন্ত্রস্ত পশ্চিমবঙ্গের একটি প্ৰ(!)খ্যাত বেসরকারি হসপিটাল। করোনা আবহে এবং সম্ভবতঃ স্টাফবিহীনতায় এন 95 মাস্ক এর থেকেও বেশি স্ক্রিনিং এর পর রোগীকে ভেতরে যেতে দেওয়া হচ্ছে। প্রথমে ভিডিও কল-এ রোগীর আত্মীয়কে সহস্রাধিক প্রশ্ন করা হচ্ছে, লজিক্যাল রিজনিং থেকে জেনারেল য়্যাওয়ারনেস প্রায় সবকিছুই থাকছে সেই বিচিত্র প্রশ্নবিচিত্রায়। দশজনের দুজন রোগী এই প্রশ্নের ধাক্কায় বিদায় নিচ্ছেন। ও, তারও আগে, এই ভিডিও কল এর লাইন এ দাঁড়িয়ে  ওপারে কাউকে না পেয়ে বিদায় নিচ্ছেন প্রায় মরে যাওয়া, হাত পা ভাঙ্গায় আর্তনাদ-রত রোগীরা, সেটিও দশটির মধ্যে দুটি। ভিডিও কলের পর রোগী খোলা আকাশের নিচে স্ট্রেচার বা হুইল চেয়ার এ বসে অপেক্ষা করছেন ভেতরের অথবা পরপারের ডাক আসার, এই শবরীর প্রতীক্ষায় বিদায় নিচ্ছেন আরো দুজন।বাকি চারজনকে খপ করে ধরে ঝপ করে ভেতরে ঢুকিয়ে নেওয়া হচ্ছে এবং তাতে কোনো বাড়ির লোককে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। এরপর শুরু হচ্ছে বাড়ির লোকের অন্তহীন প্রতীক্ষা, যার সময় গড়ে তিন থেকে পাঁচ ঘণ্টা। প্রায় জনা পঞ্চাশেক বাড়ির লোকের জন্য খোলা আকাশের নিচে চারটি চেয়ার ছেলেবেলার মিউজিক্যাল চেয়ার এর রোমাঞ্চ ফিরিয়ে দিচ্ছে। এই প্রতীক্ষার অবসানে, ভেতরে একজন আত্মীয়কে ডেকে নেবার পর কোয়ার্টার বা হাফ-মৃতদের হস্তান্তর করে পরের দিন ওপিডি দেখাবার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এর মাঝে রোগীকে ভর্তি করা হবে ধরে নিয়ে সাতদিনের ওষুধ কিনে জমা দিতে হচ্ছে, এবং তারপর রোগীকে ছেড়ে দিয়ে সেই ওষুধ কালগর্ভে বিলীন হতে দেখা যাচ্ছে, কিন্তু সে সব 'সামান্য ঘটনা' থাক বরং।

এই রণক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে, থুড়ি, হুইলচেয়ার এ বসে, রনেন মন্ডল ও ভবেশ মাঝি, দুজনেই পূর্ববর্ণিত দুটি রাউন্ড (ভিডিও কল এবং পার্সোনাল ইন্টারভিউ) ক্লিয়ার করেছেন বলে অসুস্থতার মধ্যেও সামান্য খুশি নিয়ে বসে ছিলেন ঘন্টা দুয়েক। এর মাঝেই উশখুশ শুরু করেন দুজনেই এবং দু ঘন্টা পেরনোর পর মৃদু বাপ-বাপান্তও। এরপর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসেন এক দেব-দূতিকা য়্যাটেন্ডেন্ট, থার্মাল স্ক্যানার এর গয়না ধরে।

"রনেন মন্ডল কে?" জিজ্ঞাসা তাঁর।

অরিজিনাল রনেন মন্ডল গত দুঘন্টা ধরে প্রচুর উষ্মা জানিয়ে বউ এর হাতে দুটি বিস্কুট ও একঢোক জল খেয়ে হুইলচেয়ার এ ঝিমোচ্ছিলেন, এই ডাক শুনতে পাননি।

ভবেশ বাবু ড্রেনের পাশে জঙ্গলের ধারে বসবার জন্যেই বোধহয় মশা তাড়াতে তাড়াতে বেশ সজাগ ছিলেন। এই সুযোগে তিনি দিলেন হাত তুলে, যেমতি হস্ত উত্থান করে নার্সারি বালকে, দিদিমনির রোলকলে।

য়্যাটেন্ডেন্ট সেই দেখে খাতা নিয়ে এলেন ভবেশ বাবুর কাছে। জিজ্ঞাসা করলেন, "আপনিই রনেন মন্ডল, আপনারই ডায়ালিসিস তো?"

ভবেশবাবু থমকে গেলেন। এদিকে রনেন বাবুর স্ত্রী, যিনি ষাটোর্ধ্ব এবং গত দুঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তিনি এই ঘটনাপ্রবাহের আশেপাশে এসে পড়েন। তিনি 'ডায়ালিসিস' শব্দবন্ধ শুনেই আরো সজাগ হয়ে বলেন "আমার পেশেন্ট এরও ডায়ালিসিস ছিল যে? অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে আমরা!"

য়্যাটেন্ডেন্ট জিজ্ঞাসা করেন "কি নাম আপনার পেশেন্ট এর"?

রনেন বাবুর স্ত্রী নাম বলতেই য়্যাটেন্ডেন্ট ঘুরে তাকান ভবেশ মাঝির দিকে, "ও দাদু, তুমি রনেন মন্ডল বললে যে?"

ভবেশ বাবু আত্মসমর্পণ করলেন, "তোমরা তো এই বাইরে বসিয়ে রেখেছো মা, বুকের ব্যাথায় আর মশার কামড়ে নাম ভুলে গেলে কি করি বলো?"

য়্যাটেন্ডেন্ট রেগে উঠতে উঠতেও ফিক করে হেসে রওয়ানা দেয় রনেন মন্ডল এর হুইলচেয়ার ঠেলতে ঠেলতে। "কি যে করেন না দাদু"।

Saturday, March 28, 2020

আই লীগ,মোহনবাগান, অথবা সুখ অসুখের দোটানা

(লেখাটা ওয়েবম্যাগ চার নম্বর প্ল্যাটফর্মে প্রকাশ হয়েছে। নামকরণ করেছেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য। আনএডিটেড ভার্সন ও লিঙ্ক রইল)

'ক্লাবটা বেচে দিলো'? আমার মত শখের ফেসবুক মোহনবাগানি নয়, যারা খেলাটা মাঠে গিয়ে দেখেন, হাসেন, কাঁদেন, গালাগালি দেন, মাথায় তুলে নাচেন, ঝগড়া করেন, সেই খাঁটি লোকগুলোকে থম মেরে যেতে দেখেছিলাম এটিকের সাথে সংযুক্তিকরণ এর খবরটা আসার পরে। আমি নিশ্চিত, যে সমস্ত ইস্টবেঙ্গল সমর্থক এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রায় একশোবছর ধরে বংশানুক্রমে উপভোগ করছেন , যাবতীয় কটূক্তি সত্ত্বেও খানিকটা বিরক্তিমিশ্রিত অসহায়তা তারাও অনুভব করেছেন। কলকাতা লীগ, ডুরান্ড বা বাংলাদেশ সফর এর ব্যর্থতার পর এই খবর কফিনে শেষ পেরেক ঠোকার শব্দের মতই শুনিয়েছিল ক্লাবপাগল মানুষগুলোকে। হবে নাই বা কেনো? মরসুমের শুরুতে স্পন্সর এর অনিশ্চয়তা, বিদেশি কোচ যিনি ময়দানি ভাষায় যোগ রাখতে পারেন না সমর্থকদের সাথে, অন্যতম ভরসা চামরোর ব্যর্থতা, এসবও তো দেখতে হয়েছে ওনাদের।

আইলিগ এর শুরুতেই হোঁচট, যার মধ্যে চার্চিল এর বিরুদ্ধে চারগোল হজম, শৌখিন বাবু সমর্থকরা তো হিসেবের খাতা থেকে ক্লাবটাকেই প্রায় বাদ দিয়ে ফেলেছিলেন। এরপরের ইতিহাসটা কিন্তু দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তন এর। জানুয়ারির মাঝামাঝি সুখের দিন এর সমর্থকরাও নড়ে বসতে বাধ্য হলো চিরশত্রু-বিজয়ের পর। ব্যক্তিগতভাবে মনে করতে পারি, মোহনবাগান কোনো একটা ম্যাচে নিজেদের মধ্যে টানা একুশটা মাঠজোড়া নয়নাভিরাম পাস খেলে উপরে উঠে আসার ভিডিও দেখে ছিটকে গিয়ে কলকাতা টিভিতে খেলা দেখতে শুরু করি আমি।

তারপর এলো ১০ই মার্চ। চেন্নাই সিটি ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধে অল্পের জন্য ফসকে যাবার পর, বর্তমান সময়ের নেমেসিস আইজল এফ সি সংহার মরশুম জোড়া বিশ্বস্ত বাবা দিওয়ারার গোলে, পঞ্চমবার জাতীয় লীগ বা আই লীগ জয় চার ম্যাচ ও প্রায় একমাস হাতে থাকতে। সেই আইজল, যাদের হাতে শেষ মুহূর্তে শেষ হয়েছিল ২০১৬-১৭'র চ্যাম্পিয়নশিপ এর দৌড়। স্প্যানিশ কোচ কিবু ভিকুনার অভিভাবকত্বে, গোলমেশিন বাবা দিওয়ারার দাপটে, হৃৎপিন্ড ফ্রান গঞ্জালেজ, মস্তিষ্ক জোসেবা বেইতিয়া, শিরদাঁড়া মোরান্তের নেতৃত্বে নাওরেম, শেখ সাহিল, শুভ ঘোষরা গরুর গাড়ির মেজাজে শুরু হওয়া মরসুমকে বোয়িং এর স্বাচ্ছন্দ্যে শেষ করল আর ছুঁয়ে ফেললো ডেম্পোর রেকর্ড আর আধুনিক ভারতীয় ক্লাবফুটবলের প্রবাদপ্রতিম কোলাসোকে।

খুশি? সবাই। শেষ ২০১৪-১৫ জয়ের দ্রোনাচার্য সঞ্জয় সেন খুশি। তবে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন কোনো বাঙালি কোচ মরসুমের শুরুর এতবড় ব্যর্থতা পেরিয়েও ক্লাবকর্তাদের আনুকূল্য পেতেন কিনা। সাথে মনে করিয়ে দিয়েছেন একের পর এক ক্লাব বন্ধ হয়ে যাওয়া ভারতীয় ফুটবল এর বর্তমান আই লীগ সে সময়ের ১৪ দলের আইলীগের থেকে একটু হলেও আলাদা। পোড় খাওয়া ময়দানি সুভাষ ভৌমিক অবশ্য এ ব্যাপারে দ্বিমত। তারমতে ভারতীয় ফুটবল এ মুহূর্তে আরো কঠিন কারণ আগে কেবলমাত্র গোয়া আর মুম্বাই ঘরানার মোকাবিলা করতে হত, সেখানে এখন দেশের প্রত্যেক কোণা থেকে ক্লাব, যাদের ধরণ-ধারণ ও মাঠের চরিত্র আলাদা। সুভাষ আরো উচ্ছ্বসিত কারণ তার মতে মূর্খরা বুঝেছে ফুটবলটা এখনো কলকাতার। টিপ্পনি কেটেছেন কালো কাপড় ঝুলিয়ে অনুশীলন করতে হয়নি কিবু ভিকুনাকে এই সাফল্যের জন্য। সেই কিবু, যিনি বলেছেন তিনি রাত জাগলে ফুটবলাররা আনন্দ করতে পারবে, তাই মরশুম শেষ হবার আগে কোচের ছুটি নেই। আইজল ম্যাচ এর খেলায় খুশি ছিলেন না স্প্যানিশ টেকনিক ও সৌন্দর্যঘরানার কিবু, জানিয়েছেন গোল পাওয়ার চাপে খেলা ভালো হয়নি, তাই ডার্বিতে নজর রাখতে চান। কর্তারা খুশি। ক্লাববিক্রির অপবাদ (?) শুনতে হয়েছে। স্প্যানিশ বাস ড্রাইভার এনেছেন বলে কটূক্তি শুনতে হয়েছে। কল্যানী স্টেডিয়ামকে হোমগ্রাউন্ড বেছে নেওয়ার ঝুঁকি নিতে হয়েছে, যদিও সে জায়গা দিনের শেষে আবেগে দলকে সবম্যাচে মনস্তাত্বিক লিড দিয়েছে।

কিন্তু সত্যিই কি সব এতটাই সুখের? জয়ের প্রাবল্যে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসা (এই লেখার সময় পর্যন্ত) চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীকেও যখন বামন লাগছে, তখন অপ্রিয় দু-একটা কথা বলা কি দরকার? এই যেমন, ভারতীয় ফুটবল লীগ জিতে স্প্যানিশ পতাকা মোড়া সেলিব্রেশন-এ কেন ধীরে ধীরে বাংলার মাঠ থেকে সাফল্যের আলো সত্ত্বেও অন্ধকারে হারিয়ে গেলেন বাংলার কোচ ও হাতে গোনা কয়েকজন বাদে বাংলার ফুটবলার-রা? অথবা, সামনের মরশুমে কি হবে 'আমাদের' মোহনবাগানের 'কর্পোরেট' এটিকের হাতে পড়ে? কর্তারা যতই বলুন পরিকল্পনা আছে, সামনে স্পষ্ট কিছু আলোর রেখা নেই। তবে সুখের দিনে থাক না সেসব কূটকচালি।

https://4numberplatform.com/?p=17809