Tuesday, May 22, 2018

ঘুম ও জেসুদাস

কখনো কোন সমান্তরাল বিশ্বে, রেষারেষি আর স্বার্থপরতার ঝকমকে আলো কমে এলে পর, কিশোর রফি মান্না ইত্যাদি গুরুপুজোর ভক্তদের হইহুল্লোড় ফিকে হবার পরে, ঝড়ের পরের ঠান্ডা হাওয়ায় মাটির পিদিম জ্বালিয়ে গান গাইতে বসেন কাট্টাসেরি জোসেফ জেসুদাস।

জেসুদাস এর গান এর প্রতিবেশী বাজনা ও বাহুল্যরা মন বসাতে পারে না কাজে, কেমন যেন ঝুম মেরে ভগবানের গলা শুনতে বসে মাটির মেঝেতে থুবড়ে নিজের কাজ ভুলে, ঠান্ডা শরীরে ভাবুক স্যাক্স শোনে "য়্যায় মেরে উদাস মন, চল দোনো কহিন দূর চলে, মেরে হামদম, তেরে মঞ্জিল ইয়ে নেহি ইয়ে নেহি কোই অওর হ্যায়"।

রাত বাড়লে ফেরবার রাস্তা পেরিয়ে যাবার পথে চাঁদ আবদার ধরে "চাঁদ আকেলা জায়ে সখী রে, মন মোরা ঘাবরায়ে রে" শুনবার, সে একটু ডুবতে দেরি হোক বরং একলাইন "ও বৈরাগী, ও মনভাওন, কব আয়েগা মোরে আঙন" এর মনকেমনের টানে।

ক্যালেন্ডার এর পাতা থেকে রাধামনি নেমে আসেন "কা করু সজনী, আয়ে না বালাম" এর অপেক্ষার পুজোর দু ফোঁটা চোখের জল ফেলতে। অন্ধ কৃষ্ণপুজো তো অনেক হল, ঐ ম্যাজিক গলার "ইয়ে জগ সারা, নিদ সে হারা, মোহে নিদ না আয়ি" স্তব, সে কি কম কাছের?

সব শেষে ইনসমনিয়ায় ভোগা দেবাদিদেব মুখ ঢেকে জেসুবাবুর কুটিরের পেছনের দরজা দিয়ে আসেন একে একে বাকিরা বিদায় নিলে। জেসুবাবু মুচকি হেসে তানপুরা তুলে গলায় মোলায়েম স্বর্গমাখা সুর তুলে নেন ঘুমপাড়ানিয়া অনুরোধে ...

"কোই গাতা ম্যায় শো যাতা" শুরু হয় অদ্ভুত মায়ার হাত বুলিয়ে গলার কাছে জমে থাকা বিষের জ্বালা ভুলিয়ে, "কোই মেরা শর গোদি মে রাখ সহলাতা, ম্যায় শো যাতা"র হাতপাখার মিঠে হাওয়ায় ঘুম নেমে আসে চোখে।

জেগে থাকেন, টিমটিম করে তারাদের সাথে আলো দিতে থাকেন কাট্টাসেরি জোসেফ জেসুদাস।

Sunday, May 20, 2018

বাফ ছেড়ে বোদ্ধা সাজার সহজ উপায় ১

2012 সালে সাইট এন্ড সাউন্ড পত্রিকা দুনিয়াভর এর স্বনামধন্য চিত্রপরিচালকদের নিয়ে বিশ্বের সর্বকালের সেরা চলচ্চিত্র বিষয়ে একটি সমীক্ষা করে। প্রথম স্থানে উঠে আসে একটি জাপানি সিনেমা যা প্রথম স্থানের দৌড়ে একেবারেই ছিল না। এমনকি একই সার্ভেতে ক্রিটিক্স বিভাগেও সেই একই সিনেমা, যার নাম 'টোকিও স্টোরি', তৃতীয় স্থান অধিকার করে।

ছবির সময়:1953
পরিচালক: ইয়াসুজিরো ওজু

এক বৃদ্ধ দম্পতি যাঁরা তার ছোট মেয়ের সাথে মফস্বলে থাকেন, তারা দেখা করতে আসেন তার ছেলে মেয়েদের সাথে প্রথমবার যুদ্ধোত্তর ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন এর পদধ্বনি ওয়ালা টোকিও শহরে। ছোটখাটো ডাক্তার বড় ছেলে, বিউটি পার্লার চালানো বড় মেয়ের সাথে থাকার সীমাবদ্ধতা ধরা পড়ে শিগগিরই, যদিও তাতে তাদের স্ত্রী বা স্বামীর ভূমিকা কখনোই প্রধান হয় না। মেজ ছেলের বিধবা স্ত্রী একমাত্র ভরসা হয় অচেনা শহরে। বুড়ো এক রাত্রে কিছু পুরোনো টোকিওপ্রবাসী বন্ধুদের সাথে পানভোজন এর আধিক্যে করেন আত্মসমীক্ষন ও খানিকটা সমাজ এর মূল কাঠামোর বদলের পর্যালোচনা। ফিরে আসার পথে ওসাকা তে রেলচাকুরে ছোট ছেলেও খুব একটা আশা জাগায় না। বুড়ো বুড়ি ফিরে আসেন নিজের জায়গায়। বুড়ি মারা যান। ছেলে-মেয়েরা ব্যস্ত সময় থেকে একচিলতে সময় বার করে দায়িত্ব পালন করতে আসে। ফিরেও যায়। বুড়ো আর বিধবা বৌমা, বিধবা বৌমা ও ছোট মেয়ের কিছু সংলাপে ধরা থাকে আধুনিক সভ্যতা ও পরিবারের মধ্যের টানাপোড়েন গুলো।

বিয়ে না করে সারা জীবন মায়ের সাথে কাটানো পরিচালক (সূত্র: আই এম ডি বি) তার স্বভাববসতই হেলে থাকেন পুরনো পারিবারিক মূল্যবোধের দিকে, কিন্তু কখনই তিক্ততা আনেন না, বরঞ্চ বার বার জোর দেন আত্মসমীক্ষন বা বদলের অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে। স্থির, মাটি থেকে তিন হাত মাত্র ওপরের ক্যামেরায় নেয়া অধিকাংশ শট ছবিকে একটা সিগনেচার স্থিরতা আর গ্রাউন্ড রিয়ালিটিসংলগ্নতা দেয়। গোটা ছবি প্রশ্ন করতে থাকে বারবার একটা ধারণাকে, 'এ চাইল্ড কান্ট সার্ভ হিজ পেরেন্টস আফটার গ্রেভ'। উত্তরও আসে, তবে তা সাদা বা কালো হয় না, ধূসর এই ছবির আত্মা। মিনিমালিস্টিক, জাপানি কালচারের মতই এ ছবির বক্তব্য।

আই এম ডি বি ট্রিভিয়া বলছে, সত্যজিৎ রায় ছবিটি দেখতে দেখতে শেষের দিকে একটু ইমোশনাল হয়ে পড়েন। কতটা ঠিক জানা নেই, কারন, সত্যজিৎ বাবু নিজে অপরাজিত করার ভাবনা শুরু করেন মা মারা যাবার পর অপুর মনের চাপা খুশির বৈপরীত্বে ইন্টারেস্টেড হয়ে ('মাই ইয়ার্স উইথ অপু')। কিন্তু মনে হল টোকিও স্টোরি ছবির আত্মা জাপানি ছবি ভক্ত পরিচালকের 'শাখা প্রশাখা'তে ফিরে এসেছে একটু হলেও।

বুড়ি টোমির সাথে ছোট নাতির ঘাসের উপর খেলা, বিধবা মেজ বৌ এর তিক্ত দাম্পত্য স্মৃতি ও নতুন দুনিয়ার হাতছানি উপেক্ষা করে অভ্যাস এর গোলামী, সমুদ্রতীরে সৈকতাবাসে বুড়ো বুড়ির আত্মসমীক্ষন, বুড়ির মৃত্যূর পর ছেলেমেয়েদের ও বাবার মুখোমুখি সংলাপ, ছবির শেষ হওয়ার পরেও সামনে ভাসতে পারে।

কখনো সময় হলে, যা এই ছবির মধ্যবয়সী পাত্রপাত্রী বা আমাদের একেবারেই হয় না ঝুটো এবং ঠুনকো প্রায়রিটির জন্য, দেখে নেয়া যেতেই পারে।

Tuesday, May 15, 2018

দি ইকোনমিক টাইমস (রিপ্লাগ)

দু হাজার চার এ যখন টুম্পা আমি গ্রাফাইট ইন্ডিয়া লিমিটেড এ সার্টিফাইড কয়লা কুলির চাকরি ছেড়ে এমবিএ নামক তৎকালীন আলাদিন এর আশ্চর্য প্রদীপটি হাতাবার অপচেষ্টায় কলকাতা নামক 'বিশাল' শহরে আসি যথাক্রমে মফস্বল আমার মনের শহর মেদিনীপুর ও তৎপরবর্তী আরেক মফস্বল আমার নেমেসিস শহর দুর্গাপুর ছেড়ে, আমার শুভাকাঙ্খী কলিগ কাকু, যিনি এখন একটি নামী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর হেড অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট, তিনি ভেঙে পড়া ভীত আমিকে পার্টিং উপদেশ ছুঁড়ে মারেন: "সার্থক, সবসময় মনে রাখবে দুনিয়াটা কিন্তু অনেক বড়", যা নিয়তির ডাকে বা কালসর্প দোষে বীভৎস রকম মনে ধরে আমার।

তৎকালীন ক্যামাক স্ট্রিট এ একটি এমবিএ এন্ট্রান্স টেস্ট কোচিং সেন্টার এ ভর্তি হই যা ছিল সম্ভবত বিদুর কাপুর নামে একজন আইআইএম য়্যালুমনির এন্ত্রেপ্রেনিউরল প্রতিষ্ঠান। এহেন হনু বিদুর বাবু, যিনি নামের মাহাত্মে প্রাচীন কালে ধৃতরাষ্ট্র থেকে সকলকেই ফ্রিতে জ্ঞান বিতরণ করে বিরক্ত ও তাড়না করে আসছেন, তার অত্যন্ত ঝকঝকে বহিরাঙ্গ এবং ততোধিক ফরফরে ইংরেজির কারণে প্ৰথম দিনই আমার মনে তুমুল তৃণমূল স্তরে মনোনয়নবিহীন প্রভাব বিস্তার করেন, যার কারণ মূলতঃ দুটি। এক, উনি আমার পূর্বোক্ত কাকুর বড় পৃথিবী দৈববানী পুনরাবৃত্তি করেন ও চাকরি ছেড়ে বাবার পয়সায় বাবুয়ানি করতে আসার পাপবোধকে বুর্জোয়া দক্ষতায় ধামাচাপা দেন। দুই, তার ইংরেজি ভাষাদক্ষতা ও বাচনশক্তি, যা বাংলামিডিয়ামাটাইটিস ও দেখমফতুইক্যাবলাকেমনাইটিস এ ভোগা রোগাভোগা আমাকে এ প্লাস গোত্রের বিজনেস স্কুলের জন্নতের দরজায় আইসিসজেহাদি টোকা মারার স্বপ্না্দ্য চুলকুনি উপহার দিতে সফল হয়।

সে যুগে চোখ বুজে আমি যেকোন লোককে ভক্তদের করা মুদিবাবুকে বিশ্বাস এর মত লালায়িত বিশ্বাস করতাম, যদি তিনি একটু চকচকে দেখতে ও ভাল ইংরেজি বলতে পারতেন।

তো এই বিদুরবাবুর চাকচিক্যের প্রভাবে আমি একটি যৌবনের কুঅভ্যাসে পড়ি প্রথমবার। দি ইকোনমিক টাইমস নামক পত্রিকার গ্রাহক হয়ে পড়ি। বিদুরবাবুর বাতবাজি আমায় কনভিন্স করে, যতদিন না কেউ এই মহান চোরদুনিয়ার মুখপত্র লিটিল ম্যাগাজিনটির পাতা না উল্টোবে, ব্যবসায়িক দুনিয়ার আঁতেলরা ততদিন তোমাকে সাপ্তাহিক বর্তমান এর মতই অচ্ছুৎ করে রাখবে।

আমি প্রথম দিন এই পত্রিকাটির চারপাতা পড়ি, দ্বিতীয়দিন দুপাতা, তৃতীয়দিন একপাতা, চতুর্থদিন এক কলম, পঞ্চমদিন একটি খবর, ষষ্ঠদিন থেকে দিলীপবাবুর মার্কশিট পাওয়ার মতন পড়া অর্থাৎ পড়া বন্ধ হয়। কিন্তু এই নিষিদ্ধ বস্তুটির লাল মার্কসীয় রঙ, বেচবার পরে মোটা দাম (সম্ভবত একটাকা প্রতি কেজি বেশি), আরো না জানি কি, এতটাই প্রভাব বিস্তার করে, নেশার ঘোরে আমি প্রতি মাসে ঐ নিষিদ্ধ জিনিস নিতে, জমা করতে ও বেচতে থাকি। সব খারাপেরই শেষ থাকে, একদিন এন্ট্রান্স এগজাম এর রেজাল্ট বেরোতে আমার মসজিদদৌড় বন্ধ হয় এবং আশার য়্যালকোহলসমাধি ঘটে। ধাক্কা পেয়ে প্রথম কাজ হিসেবে আমি এই সাবস্ক্রিপশন বন্ধ করি এবং আশ্চর্য্যজনক ভাবে একমাসের মধ্যে একটি নবরত্ন কোম্পানিতে ঠিকঠাক একটি চাকরি জোগাতে সক্ষম হই।

ঠিক এর চার বছর পরে, সেই পূর্বোক্ত কাকুর অমোঘ দার্শনিক বড় দুনিয়ার লাইন আমার বেওকুফ বোহেমিয়ানাকে আবার কামড়ে দেয়, এবং এমবিএ হওয়ার কামজ্বর এ পুনরাক্রান্ত হয়ে আমি চাকরি লাথি মেরে কোনমতে গড়ের মাঠের শহরের বুকে একটি ইন্ডাস্ট্রি স্ট্যান্ডার্ড এ গড়পড়তা কিন্তু আমার ব্যক্তিগত যোগ্যতার গড়ের উপরের বিগ্রেড বি স্কুলে ভর্তি হই।

ফ্যাকাল্টি হিসেবে এক ভদ্রলোককে পাই যিনি প্রচন্ড দুর্মুখ এবং সকলকে অপমান করা সদর্পে জীবনের ব্রত হিসেবে বেছে নিয়েছেন। আমার কর্পোরেট জগতের অভিজ্ঞতায় তখন আমি সেই লোকদেরই বিশ্বাস করতে শুরু করেছি যারা প্রচন্ড অপমান করেন ও অপমানটাকে শিল্পের (চপ নয়) পর্যায়ে নিয়ে যান। সম্ভবত তারাপদবাবুর রচনায় পড়েছিলাম যে ডাক্তারবাবু যত দুর্মুখ তত বেশি তার পসার, এরকম এক পাগলের ডাক্তারবাবু তার রোগীদের প্রচন্ড অপমান করতেন ও প্রায় সুস্থ করে আনতেন ও শেষে একদিন অপমান করতে করতে কামড়ে দিতেন এবং রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে বাড়ি যেত। সেই 'তারা'বাজি থাক এখন। মোটের ওপর এই ভদ্রলোকের অপমানে মেসমারাইজড হয়ে ওর উপদেশানুসারে আমি আবার ইকোনমিক টাইমস নিতে এবং আবার না পড়তে শুরু করি।

দেড় বছর পরে, দু হাজার দশ নাগাদ, আমি হঠাৎ করে আবিষ্কার করি ইকোনমিক টাইমস এর নিষ্কলঙ্ক পাতার মতই যেকোন কারনে আমার চাকরির ভাঁড়ার শূন্য যেখানে প্রায় আধা ডিপার্টমেন্ট মোটের ওপর একটা করে চাকরি হাতের মুঠোয় নিয়েছে।

শোকাহত হয়ে, মাঝরাত্তিরে, একান্তে, তুমুল চানাচুরসহ জলপথে গভীর ইন্ট্রোস্পেকশনে বসে যখন আমি আমার এই চরম গঙ্গাপ্রাপ্তির পরিণতির গোমুখসন্ধানে ব্যস্ত, তখন চোখে পড়ে ঘরের কোনের ইকোনমিক টাইমস এর বোঝার দিকে। বিশ্বাস করবেন না, ঝপ করে মাথাটা কেমন যেন পরিষ্কার হয়ে যায়। সারারাত না ঘুমিয়ে ভোর পেরনোর পরে প্রথমে কাগজদাদার হাত থেকে আনন্দবাজারটা নিয়ে ইকোনমিক টাইমস টা নিতে বিপ্লবী অস্বীকার করি ও প্রথম যে বেসুরেলা কাগজওয়ালা পাই, তাকে ধরে এনে পুরনো সতীসাধ্বী কাগজগুলোকে বিদায় করি। সেই দেবদূত কাগজওয়ালা আমায় জীবনে প্রথম ও শেষ ব্যক্তি হিসেবে আমাকে জানায় যে আমার খুব যত্ন, ভাঁজ না খোলা ইকোনমিক টাইমস এর প্রভাব ও দিব্যি!

ভগবানের বা কার্ল মার্ক্স এর অশেষ দয়ায় এর এক-দু সপ্তাহের মধ্যেই কি ভাবে যেন একটি কাজ চালানো চাকরির জোগাড় হয়।

এই অকিঞ্চিতকর লেখার একটাই উদ্দেশ্য। কোন ছোট ভাইবোন যদি তাদের বেসিক নেসিসিটি গুলো ছুঁতে পাচ্ছে না শত চেষ্টা করেও, অথচ গ্রহের ফেরে পড়ে ফেলেছে এই প্রলাপরচনা, দেখুন না চোখ বুলিয়ে, ঘরের বা মনের এক কোনে কোন ইকোনমিক টাইমস এর জঞ্জাল জমিয়ে রাখেন নি তো?

বিদায় করুন।

ভালো থাকুন!