Friday, August 23, 2019

বাজে গল্প ৩

সুধন্য ঘোষাল ধেনো খেতে ভালোবাসতেন। বৌদির হোটেলের পেছনের দরজায় ব্লাডার থেকে সরাসরি গ্লাসে ঢালা বসিরহাট থেকে আমদানি করা ধেনো গলা দিয়ে নামতো যখন, সুধন্যর মনটা চুলকে উঠতো আনন্দে।

রোজকার মতো বিকেলে সেই দেবভোগ্য ধেনোতে চুমুক মেরে বুঁদ হয়ে গঙ্গার জলে পা ডুবিয়ে বসেছিলেন সুধন্য আর আকাশপাতাল ভাবছিলেন। পাড়ের মন্দিরটার চাকচিক্য ফিরেছে বছরখানেক হলো। জগন্নাথ পন্ডিত রাধাকেষ্ট নিয়ে বসে থাকতেন যে কালে, দু চারটে বুড়োবুড়ি আর সুধো মাতাল ছাড়া সে কেততন শোনার লোক পাওয়া যেতো না বড় একটা। এখন সে মন্দিরে বেশ বড়সড় বজ্রঙবলি, তার দ্বিধাবিভক্ত বুক এর মধ্যে হাসিমুখে শ্রীরামচন্দ্র ও সীতামাতা, সামনে বেশ কিছু ভক্ত আর টুংটাং করা দানবাক্স। জগু পন্ডিত বাতের ব্যাথায় নড়তে পারেন না। মুদিদোকানের শিউপুজনের ভাগ্নে রামশরন মিশির আজকাল বেশ দুলে দুলে হুংকার দিয়ে পুজো করে।

খানিকটা ঢুলুনি এসেছিল, ঠিক এমনসময় রামশরন এর বাজখাই গলার ডাক শুনে খোঁয়ারি চটকে গেলো সুধন্যর।

"সুধোকাকা! আবার খেয়েছো ওসব ছাইপাঁশ?"

সুধন্য ছোপ ধরা দাঁত বের করে বললেন "হেঁ হেঁ"!

"তোমায় বলেছি না, এসব ছাড়। সন্ধেবেলায় মন্দিরে এসে একটু বোসো। পুজোর কাজকম্মে একটু হেল্প টেল্প করে দাও। আমি যেদিন মিটিং এ যাই, লোকজন এসে ফিরে যায়। বলি, ব্রাহ্মণ মানুষ, একটু ধর্মকর্ম তো করতে পারো এই শেষ বয়সে এসে"।

সুধন্য আবার হেঁ হেঁ পূর্বক বললেন "সে ভাগ্নে কোনদিনই তো তেমন ..... হেঁ হেঁ"।

"ছ্যাঃ", রামশরন মাথা ঝাঁকিয়ে বলে উঠলো "তোমাদের জন্য দেশটা টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছিলো সত্তর বছর ধরে"!

সুধন্য মাথা নিচু করে স্বীকার করলেন। তারও আজকাল সবসময় মনে হয় দেশটা তার মতো লোকজনের জন্যেই ডুবে যাচ্ছে।

উদ্ধার করার শেষ মরিয়া চেষ্টা করল রামশরন। "বলো তো কাকা, বলো জয় শ্রীরাম, সব পাপ ধুয়ে মুছে যাবে"।

তিলমাত্র সময় না নিয়ে সুধন্য বললেন "জয় শ্রীরাম ভাগ্নে"! সুধন্য ধর্মতলায় বিফ ফেস্টিভ্যাল এ যোগ দেননা, বৌদির হোটেলের ঝাল ঝাল মুরগির কশা মাংসই তার কাছে যথেষ্ট। কানাঘুষো তিনি এটাও শুনেছেন জয় শ্রীরাম বললে কাটমানি দিতে হচ্ছে না আজকাল, যদিও তার কাটমানি দেবার মত কাজকারবার কিছুই নেই।

"এভাবে হবে না", শ্রীরাম এর জয়গানের মাত্রা সন্দেহজনক ঠেকলো রামশরন এর কাছে, "তোমায় আজ খুঁজে পাওয়াবো ভগবানকে"!

টানতে টানতে সুধন্য কে নদীর এক্কেবারে কিনারায় নিয়ে গেলো রামশরন। গলা ধরে ডুবিয়ে দিলো জলের মধ্যে মাথা। মন্দির থেকে লোকজন মজা দেখতে নদীর ধারে এসে জমেছে একে একে।

কলার খিমচে ধরে তুললো দু সেকেন্ড পরে। জিজ্ঞাসা করলো "পেলে রামচন্দ্রকে? মন যখন একদিকে যাবে তখনই পাওয়া যায় ভগবানকে"।

হাঁপাতে হাঁপাতে সুধন্য বললেন "না, ভাগ্নে"। গলার স্বরে যার পর নাই লজ্জা মিশে।

পাড় থেকে হা হা করে হেসে উঠলেন ভবতারন মুখুজ্জে। "তোর সমাজ সংস্কার আর হলো না ভাগ্নে"।

জেদের বশে আবার সুধন্যর মাথাটা ডুবিয়ে দিলো জলে রামশরন। এবারে অন্ততঃ পাঁচ ছ সেকেন্ড। হাত এ খামচে ধরেছে সুধন্য। আবার জল থেকে বার করে জিজ্ঞাসা করলো "পেলে রামচন্দ্রকে? না এখনও মন পড়ে আছে ওই ধেনোর ঠেকে?"।

সুধন্যর বুকের ভেতরটা হাপর এর মতো করে উঠছে। পাড় থেকে ভোলার পাঁচ বছরের যমজ ছেলেদুটো হাততালি দিয়ে উঠলো। আজ নতুন খেলা। সুধোদাদুকে ডোবানো। ফিশ ফিশ করে বলে উঠলেন সুধন্য "না রে ভাগ্নে, শুধুই অন্ধকার"!

অগ্নিশর্মা রামশরন প্রায় জলে ছুঁড়ে ফেলে মাথা চেপে ধরলো সুধন্যর। দশ সেকেন্ড। পনেরো সেকেন্ড। মজা দেখতে আসা জনতা একটু সংশয়ে, কিন্তু রামশরন এর মুখের ওপর আজকাল কথা বলে না কেউ। শেষে ভবতারনই বলে উঠলেন, "রামু, ভাগ্নে, ছেড়ে দাও ওকে, পাখির মতো শরীর, বাঁচবে না যে"!

ফোঁস ফোঁস করতে করতে সুধন্যকে গলা ধরে তুলে এনে ছাড়লো রামশরন। খাবি খাচ্চিলেন সুধন্য। একবার ধেনোতে হসপিটালের য়্যালকোহল মিশিয়ে খেতে গিয়ে ঠিক যেমনটা হয়েছিল। লাল চোখ নিয়ে অগ্নিশর্মা রামশরন জিজ্ঞাসা করে উঠলো সুধন্যকে "পেলে শালা? রামচন্দ্রকে? নাকি আবার ডোবাবো বোকাচোদা"?

সুধন্য মাটিতে শুয়ে শুয়েই প্রায় মাটির সাথে মিশে গেলেন লজ্জায়। পেট গুলিয়ে উঠছিলো। চোখে অন্ধকার। তাও ক্ষীণ কুন্ঠিত গলা অপরাধবোধে ডুবিয়ে শেষবারের মত জিজ্ঞাসা করে উঠলেন, "না ভাগ্নে, দেখলাম না, তুমি ঠিক জানো, এইখানেই ডুবে গেছিলেন উনি"?

অজ্ঞান হয়ে গেলেন সুধন্য।