Thursday, June 8, 2017

এই সময় ১

ওদিকে:

- যখন পাঁচজন 'ছোটলোক' মানুষ মুক্তি পেয়েছেন তীব্র বিকাশমুখী গোহিতৈষী সরকার বাহাদুর এর দেয় ন্যায্যমূল্যস্বরূপ বুকে সামান্য গরম ধাতুর টুকরো ধারণ করে, সারাজীবনের মতো, বৃষ্টির চিন্তা, বীজের চিন্তা, দাম পাবার চিন্তা থেকে!

- যখন সেই পাঁচজনের সাথে একই গাড়িতে গাদাগাদি করে নরকের উদ্দেশ্যে যাবার জন্য শেষ মুহূর্তে উঠে পড়েছে একটা খিলখিলানো বাচ্চা যাকে অটো থেকে ছুঁড়ে ফেলে মাথাটা থেঁতলে দিয়ে গণভোগে অরাজি মাকে শিক্ষা দেয়া গেছিল! যার শবদেহ কোলে করে বিবস্ত্রা মা প্রগতির প্রতীক মেট্রোতে চড়ে সরকারি হাসপাতালে পৌঁছেছিলেন চিরঘুম ভাঙাতে (বলিহারী শখ)!

- যখন এক ভাঁড় যুবরাজ গাল ফুলিয়ে বি গ্রেড নাটক করছেন সহমর্মিতার, ক্যামেরা সাক্ষ্য রেখে!

- যখন তথাকথিত বামপন্থা কলেজ স্কয়ারে সভা বন্ধ অথবা সীতারাম ইয়েচুরিকে দুটি এঁড়ে বাছুরের চুলকে দেবার বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক লড়াই লড়ছেন!

- যখন পাহাড় উপঢৌকনের কাতুকুতুতে হাসতে হাসতে দাম বাড়িয়ে নেবার জন্য কান্নামুখ করেছে আর তাদের ম্যানেজ করতে প্রখ্যাত ও পার্টটাইমে জেলে বাকিটা হাসপাতালে থাকা ম্যানেজাররা কলসির কানা উপেক্ষা করে প্রেম নিয়ে গদগদ!

ঠিক সেই মুহূর্তে, প্রাইমটাইমে খবর হচ্চে

- সতের বছরের 99% পাওয়া ছাত্রের সাধুর জীবন বেছে নেবার, সম্ভবত আসারাম বাপুর মহিলা উন্নয়ন বা রামদেবের এফ এম সি জি উন্নয়ন ব্রতর মুখ চেয়ে!!

- কাজকস্তানের আস্তানা'য় হতে চলা সম্মেলনে আমাদের হীরকরাজ ওদের নওয়াজ শরিফের সাথে হাত না মিলিয়ে কতটা কূটনৈতিক চাপে ফেলতে চলেছেন পাকিস্তানকে!!

- খড়্গপুরের হাইওয়েতে মিগ 21 নামিয়ে কাশ্মীরের দখল কিভাবে রাখবে আমার মহান দেশ!!

- মুসলিম অভিনেত্রীর রমজানের মাসে পরা বিকিনি ছবিতে কতখানি আহত হল অথবা রেনেসাঁর মুখ দেখল ধর্ম!!

বেশ দেশ আমার💐

আমার গ্রামে, এক অশান্ত সময়ে, রাষ্ট্রের একনায়কতন্ত্র মানতে না চাওয়া কিছু অতিসংশোধনবাদী ওয়ান শটারে রক্তের বন্যা বইয়ে দিত নিজেদের বিচারসভা শেষে, মানতে কষ্ট হত এত সহজে মেরে ফেলবার অধিকার হাতে নিতে দেখে, এখনো হবে। কিন্তু ভন্ড জাতীয়তাবাদটাকে অথবা তাদের ধ্বজা নাড়ানো সংবাদমাধ্যম গুলোকে কোপাতে দেখলে, মাইরি বলছি, হয়ত খারাপ লাগবে না!!!

Friday, June 2, 2017

একটি কঠোর প্রেমের গল্প ১

প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট আগে খবরের কাগজের ওমে ম ম করত, এখন যেন একটুকরো বড়বাজার, পুরনো বড় কাগজের অফিসেও একটা অনিশ্চয়তার হাঁসফাঁস। রূপকথা অবশ্য সাংবাদিক নয়, নিতান্তই বিজ্ঞাপনের বিপণন দেখা তরুণী সেলস ম্যানেজার। এক্সিকিউটিভরাই সবকিছু করে ফেলে, তার কাজ শুধু সুপারভিশন আর রিপোর্টিং, এখনো এই কাগজের নামেই বিজ্ঞাপন আসে, তাই চিন্তা কম।

সাড়ে এগারটা নাগাদ এক কাপ চা নিয়ে করিডরে দাঁড়িয়ে কাজ দেখছিল রূপকথা, ছটা টেবিলেই লোক, ছজন এক্সিকিউটিভ ছজন বিভিন্ন বয়সী লোককে বিভিন্ন ভাবে সহায়তা করছে। সোফাতেও জনাচারেক লোক অপেক্ষা করছেন তাদের সময় আসার। জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ, নিখোঁজ, আনন্দ, কত কি ছাপার অক্ষরে দেখতে চায় মানুষ।

হঠাৎ করে চোখ পড়ল দরজার কাছে সিকিউরিটির জন্য রাখা টুলে বসা বয়স্কা ভদ্রমহিলাকে। নিতাইদা বোধহয় বাইরে দাঁড়িয়েছে ভদ্রমহিলাকে টুলটা ছেড়ে দিয়ে। এই মহিলাকে চেনে রূপকথা। ওদের ঝাঁ চকচকে য়্যাপার্টমেন্টের উল্টোদিকে রাস্তার ওপারে যে লো ইনকাম গ্রূপের ফ্ল্যাটগুলো আছে তাতে থাকেন। স্বামী আর একটা ল্যাব্রাডর কুকুর ছাড়া কেউ ছিল না। "ছিল না", কারন রূপকথা দেখেছে গত সপ্তাহেই স্বামী পরলোকগত হয়েছেন, এক রোববার সকালে উঠে সারা সকাল ধরে দেখেছে সেই ছোট্ট বাড়িতে গম্ভীর মুখের ভিড়, বাইরের রাস্তার ধারের থেকে ম্যাটাডোরের ওপর স্বামীকে শেষবারের মত তুলে দেবার আগে ভদ্রমহিলা চেয়ে ছিলেন অদ্ভুত দৃষ্টিতে। সে চাউনিতে কান্না জাতীয় কিছু ছিল বলে মনে করতে পারে না রূপকথা। লজ্জা পেল ওর। রূপকথার এই জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে অন্যের সংসার দেখার অভ্যাস বহুদিনের। ঠিক উল্টোদিকের এই ছোট ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা বোধহয় ঘুণাক্ষরেও জানে না ওর এই নিঃশব্দ উঁকিঝুঁকির কথা।

অবাক হত রূপকথা। অতটুকু ঘরে একটা ল্যাব্রাডর কুকুর। ঘরের আসবাব আর পোষাকআশাক দেখে খুব সচ্ছলও লাগত না এই পরিবারটিকে। ছেলেপুলে অবশ্য নেই। ওদের দোলনা আর ফুলের টব ওয়ালা মস্ত বারান্দায় দাঁড়িয়ে অনেকবার এই ভদ্রমহিলাকে গজগজ করতে শুনেছে এই কুকুরটাকে নিয়ে। আর এখন বোধহয় সেই কুকুরটাই একমাত্র আপনজন, ভাবল রূপকথা।

কোন টেবিলেই ফাঁকা হওয়ার নামগন্ধ নেই। ভদ্রমহিলাকে নিজের কিউবিকলে ডেকে নিল রূপকথা, হাজার হোক জানলা দিয়ে তার বিশ্বদর্শনের এক অসহায় পাত্রী তিনি। পরিচয় দিল না জটিলতা এড়াতে, জানতে চাইল "কিসের বিজ্ঞাপন দেবেন?"। ভদ্রমহিলা বলতে শুরু করলেন "আমার স্বামী .....", আটকে গেলেন, গলাটা ভারী হয়ে গেল বুঝি বাষ্পেতে। ভালবাসা এরকমই, ভাবে রূপকথা, ভদ্রলোক বেঁচে থাকতে এনাকে কেবলমাত্র কথা শোনাতেই শুনেছে রূপকথা, অন্ততঃ যেটুকু আওয়াজ সরু রাস্তা দূরত্ব পেরিয়ে ওদের বাড়িতে ঢুকত। "নেই বুঝি আর, আমি খুব দুঃখিত, আমি আর কি বলতে পারি, আপনার মনের অবস্থা যে কি!!!", পরিচয় না দিয়েও সহমর্মিতা দেখাতে কসুর করে না ও। "আপনি বোধহয় একটা কন্ডলেন্স জাতীয় কিছু ছাপাতে চান, তাই না?"। ভদ্রমহিলাকে বলার সুযোগ দেয় না ও, কি রকম যেন আত্মীয়ার মত সাহায্য করার নেশা পেয়ে বসে রূপকথাকে। মহিলা কিরকম হতভম্ব হয়ে কেবল মুখ দিয়ে একটা অস্ফুট শব্দ বের করতে পারেন।

মহিলা একটু অবাকও হন অপরিচিতা এই বাচ্চা মেয়েটির তাঁর পতিবিয়োগের ব্যাপারটা আঁচ করা দেখে, তবে তার বেশি কিছু নয়। রূপকথা বলতে থাকে "আমাদের এই সেকশনে এখন প্রায় সমস্ত স্পেসটারই বুকিং এসে গেছে, আপনি নিশ্চ্ই দেরিও চাইবেন না, এদিকে বেঁচে থাকা জায়গাটা আবার একটু বেশিমাত্রায় কস্টলি"। জানলা দিয়ে দেখা জীবনযাপনের মান চিন্তায় রেখেছে ওকে। "আপনি বরং খুব অল্প শব্দের মধ্যে মেসেজটা লিখে দিন, আমি চেষ্টা করছি যতটা ম্যাক্সিমাম ডিসকাউন্ট দেয়া যায়, খারাপ লাগাটা কৃপনভাবে প্রকাশ করতে কষ্ট হবে জানি, আপনার ভালবাসাটা তো দেখতে পারছি"। ভদ্রমহিলাকে অবাক করে রূপকথার চোখ দিয়ে দু-ফোঁটা জল বেরিয়ে আসে। ভদ্রমহিলা আরো হতভম্ব হয়ে যান ওর এই অযাচিত সহমর্মিতায়। হাঁ করে তাকিয়ে থাকেন।

"কই? লিখে দিন!!!" মনে করায় রূপকথা। "চেষ্টা করুন কম কথায় রাখতে"। ভদ্রমহিলা কেমন থতমত হয়ে এগিয়ে দেয়া প্যাড আর পেনটা টেনে নেন। খুব আস্তে আস্তে মুখ না তুলে খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থাকেন। 'হায় রে মন, বেঁচে থাকতে ভালবাসাটা বোধ হয় বোঝা যায় না, না থাকলে এরকম একলা আর মনখারাপে বোবা করে দেয়', জন্ম রোমান্টিক রূপকথা ভাবে। কিছুক্ষন আঁকিবুকি কেটে প্যাডটা এগিয়ে দেন ভদ্রমহিলা, তাতে লেখা "৯, নেতাজি আবাসন, পিকনিক গার্ডেন নিবাসী শ্রী ৺অনুরূপ সেনগুপ্তের প্রয়াণে আমরা ব্যথিত"। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রূপকথা, অল্প কথায় হয়েছে, এটা স্পেশাল রেটে করিয়ে দিতে পারবে, শব্দ গুনে নিয়ে বলে "আপনি চাইলে আরো খান চারেক শব্দ ঢুকিয়ে দিতে পারেন, একই প্যাকেজে হয়ে যাবে"। এইবারে ভদ্রমহিলা যেন খানিকটা খুশি হয়েই প্যাডটা আবার টেনে নেন। খান চারেক শব্দ যোগ করে প্যাডটা আবার ঠেলে দেন রূপকথার দিকে।

তাকিয়ে দেখে রূপকথা, ওতে লেখা আছে "৯, নেতাজি আবাসন, পিকনিক গার্ডেন নিবাসী শ্রী ৺অনুরূপ সেনগুপ্তের প্রয়াণে আমরা ব্যথিত। একটি ল্যাব্রাডর বিক্রি আছে"।

(অনুপ্রাণিত)

গরমের দুপুরের বাজে গল্প ১

স্ত্রী: আবার তুমি গরমের দুপুরে ওখানে? ডঃ আচার্য বারণ করেছেন না? এমনিতেই তো মাথা ..... আবার এই গরমে একটা বিপদ হয়ে না যায়!!!

কর্তা: গিন্নি, শেঠেদের এই আমবাগানে এককালে দশ গাঁয়ের বিচার বসতো, জমিদার দর্পনারায়ন এর ডাকে উড্রো সাহেব অব্দি কাছারি থেকে এসে এই আমবাগানে এসে সেবা নিতেন, আবার তারিনী যখন ম্যাজিস্ট্রেট উইলসনকে গুলি করে পালিয়ে বেড়াচ্ছে তখন বাবা ওকে এই আমবাগানে লুকিয়ে রেখেছিলেন, ইংরেজদের পোষা পুলিশের সাহস হয়নি ....

স্ত্রী: বাবা মনে? তুমি তো তোমার ঠাকুর্দার বাবার গল্প করছ, তুমি না!!! সকালের ওষুধটা...?

কর্তা: আরে রাখ ওষুধ, ঐ ব্রজর ছেলের কবরেজিতে আমি ইয়ে করি, আমাদের জমিদারির ফ্যামিলি ফিজিসিয়ান কে ছিলেন জান? ক্যালকাটা মেডিকেলের পেনেলবেরি সাহেব!!!

স্ত্রী: আরে ব্রজ আবার কে? ডাক্তারবাবুর বাবা তো বিজয়বাবু, তুমি আবার বিজয়বাবুর দাদুর কথা বলছ না তো? আর শোন, জমিদারি আর নেই, ইন্দিরা গান্ধী আজ থেকে 50 বছর আগে জমিদারি তুলে দিয়েছে, কবার বলব তোমায়?

কর্তা: ইন্দিরাআআ!!! হুহ!!! তবে যাই বল গিন্নি, জহরের মেয়ে দেখতে কিন্তু হয়েছে একঘর!!! একবার শান্তিনিকেতনে ... থাক সেকথা!!!

স্ত্রী: তুমি তাকে নিয়েই থাকো তাহলে। দাদু দিদিমার কাছে মানুষ বলে এই মানুষের হাতে পড়তে হল আমায়। কতবার বলি চল কলকাতায় গিয়ে বাবা আর ঠাকুরপোদের বালিগঞ্জের বাড়িতে গিয়ে থাকি। তা নয়, এই ধ্যদ্ধেড়ে মালদা আর আমবাগান। আর শোন, খবদ্দার আমায় গিন্নী বলবে না, এটা কোন যুগ? আর প্লিজ, আমবাগানে বসে থাকা বন্ধ কর।

কর্তা: আরে আমবাগানে বসে থাকা এত ফেলনা নয় গিন্নি। এই তো সেদিন বুড়োবয়সে বৌমার চাপে সন্ন্যাসী রাজা না কি যেন একটা বায়োস্কোপ দেখতে গেছিলাম। তা দেখলাম বৌমাদের চোখের মণি ঐ উত্তমকুমার না অধমকুমার, সে আমবাগানেই লেঠেলদের প্যাঁচ শেখাচ্ছে, আর তুমি।

স্ত্রী: সিনেমা দেখতে গেছিলেন তোমার দাদু, আমার শ্বাশুড়ির চাপে পড়ে। তোমার এই টাইম ট্রাভেল, উঃ। তোমাকে বোঝান আমার অসাধ্য। যাই বরং ইসটিকুটুম দেখি গিয়ে। হ্যাঁগো, বিক্রম কে জেলে দেবে না তো?

কর্তা: ফুঁহ!!! বেধবা মেয়েছেলেকে ফুসলিয়ে নিয়ে কলকাতায় পালালে আজকাল আবার জেল হয় না কি? কোন যুগে যে আছ!!! তার থেকে রামতারনকে বল তামাকটা পাঠাতে।

(স্ত্রী এর হাল ছাড়ন ও রাগত বিদায়)