দু হাজার চার এ যখন টুম্পা আমি গ্রাফাইট ইন্ডিয়া লিমিটেড এ সার্টিফাইড কয়লা কুলির চাকরি ছেড়ে এমবিএ নামক তৎকালীন আলাদিন এর আশ্চর্য প্রদীপটি হাতাবার অপচেষ্টায় কলকাতা নামক 'বিশাল' শহরে আসি যথাক্রমে মফস্বল আমার মনের শহর মেদিনীপুর ও তৎপরবর্তী আরেক মফস্বল আমার নেমেসিস শহর দুর্গাপুর ছেড়ে, আমার শুভাকাঙ্খী কলিগ কাকু, যিনি এখন একটি নামী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর হেড অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট, তিনি ভেঙে পড়া ভীত আমিকে পার্টিং উপদেশ ছুঁড়ে মারেন: "সার্থক, সবসময় মনে রাখবে দুনিয়াটা কিন্তু অনেক বড়", যা নিয়তির ডাকে বা কালসর্প দোষে বীভৎস রকম মনে ধরে আমার।
তৎকালীন ক্যামাক স্ট্রিট এ একটি এমবিএ এন্ট্রান্স টেস্ট কোচিং সেন্টার এ ভর্তি হই যা ছিল সম্ভবত বিদুর কাপুর নামে একজন আইআইএম য়্যালুমনির এন্ত্রেপ্রেনিউরল প্রতিষ্ঠান। এহেন হনু বিদুর বাবু, যিনি নামের মাহাত্মে প্রাচীন কালে ধৃতরাষ্ট্র থেকে সকলকেই ফ্রিতে জ্ঞান বিতরণ করে বিরক্ত ও তাড়না করে আসছেন, তার অত্যন্ত ঝকঝকে বহিরাঙ্গ এবং ততোধিক ফরফরে ইংরেজির কারণে প্ৰথম দিনই আমার মনে তুমুল তৃণমূল স্তরে মনোনয়নবিহীন প্রভাব বিস্তার করেন, যার কারণ মূলতঃ দুটি। এক, উনি আমার পূর্বোক্ত কাকুর বড় পৃথিবী দৈববানী পুনরাবৃত্তি করেন ও চাকরি ছেড়ে বাবার পয়সায় বাবুয়ানি করতে আসার পাপবোধকে বুর্জোয়া দক্ষতায় ধামাচাপা দেন। দুই, তার ইংরেজি ভাষাদক্ষতা ও বাচনশক্তি, যা বাংলামিডিয়ামাটাইটিস ও দেখমফতুইক্যাবলাকেমনাইটিস এ ভোগা রোগাভোগা আমাকে এ প্লাস গোত্রের বিজনেস স্কুলের জন্নতের দরজায় আইসিসজেহাদি টোকা মারার স্বপ্না্দ্য চুলকুনি উপহার দিতে সফল হয়।
সে যুগে চোখ বুজে আমি যেকোন লোককে ভক্তদের করা মুদিবাবুকে বিশ্বাস এর মত লালায়িত বিশ্বাস করতাম, যদি তিনি একটু চকচকে দেখতে ও ভাল ইংরেজি বলতে পারতেন।
তো এই বিদুরবাবুর চাকচিক্যের প্রভাবে আমি একটি যৌবনের কুঅভ্যাসে পড়ি প্রথমবার। দি ইকোনমিক টাইমস নামক পত্রিকার গ্রাহক হয়ে পড়ি। বিদুরবাবুর বাতবাজি আমায় কনভিন্স করে, যতদিন না কেউ এই মহান চোরদুনিয়ার মুখপত্র লিটিল ম্যাগাজিনটির পাতা না উল্টোবে, ব্যবসায়িক দুনিয়ার আঁতেলরা ততদিন তোমাকে সাপ্তাহিক বর্তমান এর মতই অচ্ছুৎ করে রাখবে।
আমি প্রথম দিন এই পত্রিকাটির চারপাতা পড়ি, দ্বিতীয়দিন দুপাতা, তৃতীয়দিন একপাতা, চতুর্থদিন এক কলম, পঞ্চমদিন একটি খবর, ষষ্ঠদিন থেকে দিলীপবাবুর মার্কশিট পাওয়ার মতন পড়া অর্থাৎ পড়া বন্ধ হয়। কিন্তু এই নিষিদ্ধ বস্তুটির লাল মার্কসীয় রঙ, বেচবার পরে মোটা দাম (সম্ভবত একটাকা প্রতি কেজি বেশি), আরো না জানি কি, এতটাই প্রভাব বিস্তার করে, নেশার ঘোরে আমি প্রতি মাসে ঐ নিষিদ্ধ জিনিস নিতে, জমা করতে ও বেচতে থাকি। সব খারাপেরই শেষ থাকে, একদিন এন্ট্রান্স এগজাম এর রেজাল্ট বেরোতে আমার মসজিদদৌড় বন্ধ হয় এবং আশার য়্যালকোহলসমাধি ঘটে। ধাক্কা পেয়ে প্রথম কাজ হিসেবে আমি এই সাবস্ক্রিপশন বন্ধ করি এবং আশ্চর্য্যজনক ভাবে একমাসের মধ্যে একটি নবরত্ন কোম্পানিতে ঠিকঠাক একটি চাকরি জোগাতে সক্ষম হই।
ঠিক এর চার বছর পরে, সেই পূর্বোক্ত কাকুর অমোঘ দার্শনিক বড় দুনিয়ার লাইন আমার বেওকুফ বোহেমিয়ানাকে আবার কামড়ে দেয়, এবং এমবিএ হওয়ার কামজ্বর এ পুনরাক্রান্ত হয়ে আমি চাকরি লাথি মেরে কোনমতে গড়ের মাঠের শহরের বুকে একটি ইন্ডাস্ট্রি স্ট্যান্ডার্ড এ গড়পড়তা কিন্তু আমার ব্যক্তিগত যোগ্যতার গড়ের উপরের বিগ্রেড বি স্কুলে ভর্তি হই।
ফ্যাকাল্টি হিসেবে এক ভদ্রলোককে পাই যিনি প্রচন্ড দুর্মুখ এবং সকলকে অপমান করা সদর্পে জীবনের ব্রত হিসেবে বেছে নিয়েছেন। আমার কর্পোরেট জগতের অভিজ্ঞতায় তখন আমি সেই লোকদেরই বিশ্বাস করতে শুরু করেছি যারা প্রচন্ড অপমান করেন ও অপমানটাকে শিল্পের (চপ নয়) পর্যায়ে নিয়ে যান। সম্ভবত তারাপদবাবুর রচনায় পড়েছিলাম যে ডাক্তারবাবু যত দুর্মুখ তত বেশি তার পসার, এরকম এক পাগলের ডাক্তারবাবু তার রোগীদের প্রচন্ড অপমান করতেন ও প্রায় সুস্থ করে আনতেন ও শেষে একদিন অপমান করতে করতে কামড়ে দিতেন এবং রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে বাড়ি যেত। সেই 'তারা'বাজি থাক এখন। মোটের ওপর এই ভদ্রলোকের অপমানে মেসমারাইজড হয়ে ওর উপদেশানুসারে আমি আবার ইকোনমিক টাইমস নিতে এবং আবার না পড়তে শুরু করি।
দেড় বছর পরে, দু হাজার দশ নাগাদ, আমি হঠাৎ করে আবিষ্কার করি ইকোনমিক টাইমস এর নিষ্কলঙ্ক পাতার মতই যেকোন কারনে আমার চাকরির ভাঁড়ার শূন্য যেখানে প্রায় আধা ডিপার্টমেন্ট মোটের ওপর একটা করে চাকরি হাতের মুঠোয় নিয়েছে।
শোকাহত হয়ে, মাঝরাত্তিরে, একান্তে, তুমুল চানাচুরসহ জলপথে গভীর ইন্ট্রোস্পেকশনে বসে যখন আমি আমার এই চরম গঙ্গাপ্রাপ্তির পরিণতির গোমুখসন্ধানে ব্যস্ত, তখন চোখে পড়ে ঘরের কোনের ইকোনমিক টাইমস এর বোঝার দিকে। বিশ্বাস করবেন না, ঝপ করে মাথাটা কেমন যেন পরিষ্কার হয়ে যায়। সারারাত না ঘুমিয়ে ভোর পেরনোর পরে প্রথমে কাগজদাদার হাত থেকে আনন্দবাজারটা নিয়ে ইকোনমিক টাইমস টা নিতে বিপ্লবী অস্বীকার করি ও প্রথম যে বেসুরেলা কাগজওয়ালা পাই, তাকে ধরে এনে পুরনো সতীসাধ্বী কাগজগুলোকে বিদায় করি। সেই দেবদূত কাগজওয়ালা আমায় জীবনে প্রথম ও শেষ ব্যক্তি হিসেবে আমাকে জানায় যে আমার খুব যত্ন, ভাঁজ না খোলা ইকোনমিক টাইমস এর প্রভাব ও দিব্যি!
ভগবানের বা কার্ল মার্ক্স এর অশেষ দয়ায় এর এক-দু সপ্তাহের মধ্যেই কি ভাবে যেন একটি কাজ চালানো চাকরির জোগাড় হয়।
এই অকিঞ্চিতকর লেখার একটাই উদ্দেশ্য। কোন ছোট ভাইবোন যদি তাদের বেসিক নেসিসিটি গুলো ছুঁতে পাচ্ছে না শত চেষ্টা করেও, অথচ গ্রহের ফেরে পড়ে ফেলেছে এই প্রলাপরচনা, দেখুন না চোখ বুলিয়ে, ঘরের বা মনের এক কোনে কোন ইকোনমিক টাইমস এর জঞ্জাল জমিয়ে রাখেন নি তো?
বিদায় করুন।
ভালো থাকুন!