Saturday, July 6, 2024
ছবি-টবি'র গপ্পো: কিংস অফ দ্য রোড
Friday, August 18, 2023
জেনারেল বডি মিটিং
Sunday, April 9, 2023
ছবি-টবি'র গপ্পো: নানপাকাল নেরাথু মায়াককম
Sunday, August 14, 2022
গোরা
Tuesday, June 14, 2022
আত্মঘাতী বাঙালি
Saturday, November 20, 2021
টুকটাক ১
Tuesday, November 9, 2021
ছেঁড়া-খোঁড়া ১
Friday, January 8, 2021
চল্লিশ পেরোলেই!
Saturday, October 31, 2020
সত্যজিৎ ১০০ (১)
Saturday, August 29, 2020
মারিও দি আন্দ্রেদ এর কবিতা
Friday, August 28, 2020
সব ইয়াদ রাখখা জায়গা / আমির আজিজ
Tuesday, May 19, 2020
ভবেশবাবুর ভুল
করোনা-সন্ত্রস্ত পশ্চিমবঙ্গের একটি প্ৰ(!)খ্যাত বেসরকারি হসপিটাল। করোনা আবহে এবং সম্ভবতঃ স্টাফবিহীনতায় এন 95 মাস্ক এর থেকেও বেশি স্ক্রিনিং এর পর রোগীকে ভেতরে যেতে দেওয়া হচ্ছে। প্রথমে ভিডিও কল-এ রোগীর আত্মীয়কে সহস্রাধিক প্রশ্ন করা হচ্ছে, লজিক্যাল রিজনিং থেকে জেনারেল য়্যাওয়ারনেস প্রায় সবকিছুই থাকছে সেই বিচিত্র প্রশ্নবিচিত্রায়। দশজনের দুজন রোগী এই প্রশ্নের ধাক্কায় বিদায় নিচ্ছেন। ও, তারও আগে, এই ভিডিও কল এর লাইন এ দাঁড়িয়ে ওপারে কাউকে না পেয়ে বিদায় নিচ্ছেন প্রায় মরে যাওয়া, হাত পা ভাঙ্গায় আর্তনাদ-রত রোগীরা, সেটিও দশটির মধ্যে দুটি। ভিডিও কলের পর রোগী খোলা আকাশের নিচে স্ট্রেচার বা হুইল চেয়ার এ বসে অপেক্ষা করছেন ভেতরের অথবা পরপারের ডাক আসার, এই শবরীর প্রতীক্ষায় বিদায় নিচ্ছেন আরো দুজন।বাকি চারজনকে খপ করে ধরে ঝপ করে ভেতরে ঢুকিয়ে নেওয়া হচ্ছে এবং তাতে কোনো বাড়ির লোককে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। এরপর শুরু হচ্ছে বাড়ির লোকের অন্তহীন প্রতীক্ষা, যার সময় গড়ে তিন থেকে পাঁচ ঘণ্টা। প্রায় জনা পঞ্চাশেক বাড়ির লোকের জন্য খোলা আকাশের নিচে চারটি চেয়ার ছেলেবেলার মিউজিক্যাল চেয়ার এর রোমাঞ্চ ফিরিয়ে দিচ্ছে। এই প্রতীক্ষার অবসানে, ভেতরে একজন আত্মীয়কে ডেকে নেবার পর কোয়ার্টার বা হাফ-মৃতদের হস্তান্তর করে পরের দিন ওপিডি দেখাবার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এর মাঝে রোগীকে ভর্তি করা হবে ধরে নিয়ে সাতদিনের ওষুধ কিনে জমা দিতে হচ্ছে, এবং তারপর রোগীকে ছেড়ে দিয়ে সেই ওষুধ কালগর্ভে বিলীন হতে দেখা যাচ্ছে, কিন্তু সে সব 'সামান্য ঘটনা' থাক বরং।
এই রণক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে, থুড়ি, হুইলচেয়ার এ বসে, রনেন মন্ডল ও ভবেশ মাঝি, দুজনেই পূর্ববর্ণিত দুটি রাউন্ড (ভিডিও কল এবং পার্সোনাল ইন্টারভিউ) ক্লিয়ার করেছেন বলে অসুস্থতার মধ্যেও সামান্য খুশি নিয়ে বসে ছিলেন ঘন্টা দুয়েক। এর মাঝেই উশখুশ শুরু করেন দুজনেই এবং দু ঘন্টা পেরনোর পর মৃদু বাপ-বাপান্তও। এরপর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসেন এক দেব-দূতিকা য়্যাটেন্ডেন্ট, থার্মাল স্ক্যানার এর গয়না ধরে।
"রনেন মন্ডল কে?" জিজ্ঞাসা তাঁর।
অরিজিনাল রনেন মন্ডল গত দুঘন্টা ধরে প্রচুর উষ্মা জানিয়ে বউ এর হাতে দুটি বিস্কুট ও একঢোক জল খেয়ে হুইলচেয়ার এ ঝিমোচ্ছিলেন, এই ডাক শুনতে পাননি।
ভবেশ বাবু ড্রেনের পাশে জঙ্গলের ধারে বসবার জন্যেই বোধহয় মশা তাড়াতে তাড়াতে বেশ সজাগ ছিলেন। এই সুযোগে তিনি দিলেন হাত তুলে, যেমতি হস্ত উত্থান করে নার্সারি বালকে, দিদিমনির রোলকলে।
য়্যাটেন্ডেন্ট সেই দেখে খাতা নিয়ে এলেন ভবেশ বাবুর কাছে। জিজ্ঞাসা করলেন, "আপনিই রনেন মন্ডল, আপনারই ডায়ালিসিস তো?"
ভবেশবাবু থমকে গেলেন। এদিকে রনেন বাবুর স্ত্রী, যিনি ষাটোর্ধ্ব এবং গত দুঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তিনি এই ঘটনাপ্রবাহের আশেপাশে এসে পড়েন। তিনি 'ডায়ালিসিস' শব্দবন্ধ শুনেই আরো সজাগ হয়ে বলেন "আমার পেশেন্ট এরও ডায়ালিসিস ছিল যে? অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে আমরা!"
য়্যাটেন্ডেন্ট জিজ্ঞাসা করেন "কি নাম আপনার পেশেন্ট এর"?
রনেন বাবুর স্ত্রী নাম বলতেই য়্যাটেন্ডেন্ট ঘুরে তাকান ভবেশ মাঝির দিকে, "ও দাদু, তুমি রনেন মন্ডল বললে যে?"
ভবেশ বাবু আত্মসমর্পণ করলেন, "তোমরা তো এই বাইরে বসিয়ে রেখেছো মা, বুকের ব্যাথায় আর মশার কামড়ে নাম ভুলে গেলে কি করি বলো?"
য়্যাটেন্ডেন্ট রেগে উঠতে উঠতেও ফিক করে হেসে রওয়ানা দেয় রনেন মন্ডল এর হুইলচেয়ার ঠেলতে ঠেলতে। "কি যে করেন না দাদু"।
Saturday, March 28, 2020
আই লীগ,মোহনবাগান, অথবা সুখ অসুখের দোটানা
(লেখাটা ওয়েবম্যাগ চার নম্বর প্ল্যাটফর্মে প্রকাশ হয়েছে। নামকরণ করেছেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য। আনএডিটেড ভার্সন ও লিঙ্ক রইল)
'ক্লাবটা বেচে দিলো'? আমার মত শখের ফেসবুক মোহনবাগানি নয়, যারা খেলাটা মাঠে গিয়ে দেখেন, হাসেন, কাঁদেন, গালাগালি দেন, মাথায় তুলে নাচেন, ঝগড়া করেন, সেই খাঁটি লোকগুলোকে থম মেরে যেতে দেখেছিলাম এটিকের সাথে সংযুক্তিকরণ এর খবরটা আসার পরে। আমি নিশ্চিত, যে সমস্ত ইস্টবেঙ্গল সমর্থক এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রায় একশোবছর ধরে বংশানুক্রমে উপভোগ করছেন , যাবতীয় কটূক্তি সত্ত্বেও খানিকটা বিরক্তিমিশ্রিত অসহায়তা তারাও অনুভব করেছেন। কলকাতা লীগ, ডুরান্ড বা বাংলাদেশ সফর এর ব্যর্থতার পর এই খবর কফিনে শেষ পেরেক ঠোকার শব্দের মতই শুনিয়েছিল ক্লাবপাগল মানুষগুলোকে। হবে নাই বা কেনো? মরসুমের শুরুতে স্পন্সর এর অনিশ্চয়তা, বিদেশি কোচ যিনি ময়দানি ভাষায় যোগ রাখতে পারেন না সমর্থকদের সাথে, অন্যতম ভরসা চামরোর ব্যর্থতা, এসবও তো দেখতে হয়েছে ওনাদের।
আইলিগ এর শুরুতেই হোঁচট, যার মধ্যে চার্চিল এর বিরুদ্ধে চারগোল হজম, শৌখিন বাবু সমর্থকরা তো হিসেবের খাতা থেকে ক্লাবটাকেই প্রায় বাদ দিয়ে ফেলেছিলেন। এরপরের ইতিহাসটা কিন্তু দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তন এর। জানুয়ারির মাঝামাঝি সুখের দিন এর সমর্থকরাও নড়ে বসতে বাধ্য হলো চিরশত্রু-বিজয়ের পর। ব্যক্তিগতভাবে মনে করতে পারি, মোহনবাগান কোনো একটা ম্যাচে নিজেদের মধ্যে টানা একুশটা মাঠজোড়া নয়নাভিরাম পাস খেলে উপরে উঠে আসার ভিডিও দেখে ছিটকে গিয়ে কলকাতা টিভিতে খেলা দেখতে শুরু করি আমি।
তারপর এলো ১০ই মার্চ। চেন্নাই সিটি ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধে অল্পের জন্য ফসকে যাবার পর, বর্তমান সময়ের নেমেসিস আইজল এফ সি সংহার মরশুম জোড়া বিশ্বস্ত বাবা দিওয়ারার গোলে, পঞ্চমবার জাতীয় লীগ বা আই লীগ জয় চার ম্যাচ ও প্রায় একমাস হাতে থাকতে। সেই আইজল, যাদের হাতে শেষ মুহূর্তে শেষ হয়েছিল ২০১৬-১৭'র চ্যাম্পিয়নশিপ এর দৌড়। স্প্যানিশ কোচ কিবু ভিকুনার অভিভাবকত্বে, গোলমেশিন বাবা দিওয়ারার দাপটে, হৃৎপিন্ড ফ্রান গঞ্জালেজ, মস্তিষ্ক জোসেবা বেইতিয়া, শিরদাঁড়া মোরান্তের নেতৃত্বে নাওরেম, শেখ সাহিল, শুভ ঘোষরা গরুর গাড়ির মেজাজে শুরু হওয়া মরসুমকে বোয়িং এর স্বাচ্ছন্দ্যে শেষ করল আর ছুঁয়ে ফেললো ডেম্পোর রেকর্ড আর আধুনিক ভারতীয় ক্লাবফুটবলের প্রবাদপ্রতিম কোলাসোকে।
খুশি? সবাই। শেষ ২০১৪-১৫ জয়ের দ্রোনাচার্য সঞ্জয় সেন খুশি। তবে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন কোনো বাঙালি কোচ মরসুমের শুরুর এতবড় ব্যর্থতা পেরিয়েও ক্লাবকর্তাদের আনুকূল্য পেতেন কিনা। সাথে মনে করিয়ে দিয়েছেন একের পর এক ক্লাব বন্ধ হয়ে যাওয়া ভারতীয় ফুটবল এর বর্তমান আই লীগ সে সময়ের ১৪ দলের আইলীগের থেকে একটু হলেও আলাদা। পোড় খাওয়া ময়দানি সুভাষ ভৌমিক অবশ্য এ ব্যাপারে দ্বিমত। তারমতে ভারতীয় ফুটবল এ মুহূর্তে আরো কঠিন কারণ আগে কেবলমাত্র গোয়া আর মুম্বাই ঘরানার মোকাবিলা করতে হত, সেখানে এখন দেশের প্রত্যেক কোণা থেকে ক্লাব, যাদের ধরণ-ধারণ ও মাঠের চরিত্র আলাদা। সুভাষ আরো উচ্ছ্বসিত কারণ তার মতে মূর্খরা বুঝেছে ফুটবলটা এখনো কলকাতার। টিপ্পনি কেটেছেন কালো কাপড় ঝুলিয়ে অনুশীলন করতে হয়নি কিবু ভিকুনাকে এই সাফল্যের জন্য। সেই কিবু, যিনি বলেছেন তিনি রাত জাগলে ফুটবলাররা আনন্দ করতে পারবে, তাই মরশুম শেষ হবার আগে কোচের ছুটি নেই। আইজল ম্যাচ এর খেলায় খুশি ছিলেন না স্প্যানিশ টেকনিক ও সৌন্দর্যঘরানার কিবু, জানিয়েছেন গোল পাওয়ার চাপে খেলা ভালো হয়নি, তাই ডার্বিতে নজর রাখতে চান। কর্তারা খুশি। ক্লাববিক্রির অপবাদ (?) শুনতে হয়েছে। স্প্যানিশ বাস ড্রাইভার এনেছেন বলে কটূক্তি শুনতে হয়েছে। কল্যানী স্টেডিয়ামকে হোমগ্রাউন্ড বেছে নেওয়ার ঝুঁকি নিতে হয়েছে, যদিও সে জায়গা দিনের শেষে আবেগে দলকে সবম্যাচে মনস্তাত্বিক লিড দিয়েছে।
কিন্তু সত্যিই কি সব এতটাই সুখের? জয়ের প্রাবল্যে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসা (এই লেখার সময় পর্যন্ত) চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীকেও যখন বামন লাগছে, তখন অপ্রিয় দু-একটা কথা বলা কি দরকার? এই যেমন, ভারতীয় ফুটবল লীগ জিতে স্প্যানিশ পতাকা মোড়া সেলিব্রেশন-এ কেন ধীরে ধীরে বাংলার মাঠ থেকে সাফল্যের আলো সত্ত্বেও অন্ধকারে হারিয়ে গেলেন বাংলার কোচ ও হাতে গোনা কয়েকজন বাদে বাংলার ফুটবলার-রা? অথবা, সামনের মরশুমে কি হবে 'আমাদের' মোহনবাগানের 'কর্পোরেট' এটিকের হাতে পড়ে? কর্তারা যতই বলুন পরিকল্পনা আছে, সামনে স্পষ্ট কিছু আলোর রেখা নেই। তবে সুখের দিনে থাক না সেসব কূটকচালি।
https://4numberplatform.com/?p=17809
Saturday, December 7, 2019
বাজে গল্প ৪
অমিত্রসূদন বাবু বেডে শুয়েই হাঁসফাঁস করছিলেন। ডাক্তার অম্বুজাক্ষ তলাপাত্রের দুপুরের রাউন্ডের অপেক্ষাতে উৎসুক। ডাক্তারবাবু বেডের পাশে এসে দাঁড়াতেই জিজ্ঞাসা করলেন সেই প্রশ্নটা যেটা ভদ্রতা ও ভয় এর বশে করে উঠতে করতে পারেননি ভর্তি হওয়ার দিন থেকে। ডাক্তারবাবু বড়জোর একমিনিট সময় খরচ করেন রোগীপিছু রাউন্ডের সময়, বড় কোন সমস্যা না থাকলে, তাই ভনিতা কম রাখাই ভালো।
"কত সময় আছে আমার হাতে আর ডাক্তার তলাপাত্র"?
অম্বুজবাবু সকালের রিপোর্টের ওপর গম্ভীর মুখে দ্রুত চোখ বোলালেন, হেড নার্স মনসালতা মাইতিকে ডেকে খুব মৃদু স্বরে কিছু একটা দু-এক-কথা'র উপদেশ দিলেন।
"বললেন না যে ডাক্তারবাবু?" অমিত্র অস্থির।
দুপাশে অল্প একটু ঘাড় নেড়ে অম্বুজ বললেন "দশ"!
অমিত্র বিহ্বল হয়ে পড়লেন। "'দশ'??!! ছেলেকে নিউ জার্সি থেকে ডেকে পাঠাই তাহলে ডাক্তারবাবু?? ফিরিঙ্গি বে করেছে বলে মুখ দেখব না বলেছিলাম!"
তারপরে বাস্তববুদ্ধি ফিরলে নিজেকে একটু সামলে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, "ইয়ে, 'দশ' কি ডাক্তারবাবু? মাস? বছর তো নিশ্চই নয়? গড়পারের বাড়িটা বেচে দেব ভাবছিলাম, দাম পাচ্ছিলাম না, ভাবলাম বছর খানেক ধরে রাখি, অদ্দিন বোধহয়?? য়্যা??"
ডাক্তারের কালো হয়ে আসা মুখের দিকে তাকিয়ে আবার ভেবলে গেলেন অমিত্রসূদন। "তাহলে কি 'দিন' ডাক্তারবাবু? গিন্নি আজ মেয়ের বাড়ি গেছে মেয়ের ননদের আইবুড়ো ভাত-এ, বলে গেছে একটা দিন যেন না জ্বালিয়ে যেন ওর হাড়ে বাতাস লাগাই! একটা ফোন করি গিন্নিকে?"
কেবিনজোড়া নৈঃশব্দ্য। এবার নিয়তির হাতছানি ধরতে পারছেন অমিত্র। ফ্যাসফেসে গলায় শুধু জিজ্ঞাসা করতে পারলেন, "তবে কি ঘন্টা? য়্যা? ও মনসাদিদি, আজ রাতে আর ওই জ্যালজেলে স্যুপ নয়, একটু পেঁয়াজ রসুন দে' মাংস খাওয়াতে পারো? ও ডাক্তার? 'ঘন্টা'? বললে না যে?"
ঘরে ঢোকার মিনিটখানেকের মধ্যে গম্ভীর মুখে বেরিয়ে যেতে যেতে অম্বুজ বললেন "নয়"!
Wednesday, November 27, 2019
স্মৃতি
"কাকিমা, একটু চিনি দেবে? পরীক্ষার পড়া করতে রাত জাগার ব্যাপার আছে আমাদের তিনজনের, এদিকে এই রাত এগারোটায় দেখছি চা কফি করবার চিনিই নেই" ছায়াকাকিমা দরজা খুলতেই সোহম জিজ্ঞাসা করল।
সোহমরা তিনবন্ধু সস্তায় ভাড়ায় পেয়ে গেছিল কেষ্টপুর এর এই চারতলার ফ্ল্যাটটা মাসদুয়েক আগে। উল্টোদিকে শুধু ষাটোর্ধ্ব ছায়াদেবী, আর তার ক্যানসার আক্রান্ত স্বামী মনমোহন। সোহমরা তিনজনেই মফস্বল থেকে এসেছিল বলেই বোধহয়, মায়ের থেকেও বেশি বয়সী ছায়াকে দুম করে 'ছায়াকাকিমা' বানিয়ে ফেলতে সময় লাগেনি। ছায়াও ছেলের বয়সী এই তিনজনকে সামনে পেয়ে ভরসা পেয়েছিলেন, বাড়িতে অসুস্থ লোক, রাতবিরেতে যদি কখনো বিপদে পড়তে হয়। এদের মধ্যে সোহম সবথেকে মিশুকে বলেই, মনে হয় ওর সাথে যত গল্প ছায়ার, সোহমও বৃদ্ধাকে দেখে একটা মায়ায় পড়েছে, ওর গ্রামের বাড়িতে থাকা বুড়ি জ্যেঠিমাকে মনে পড়ে যায় ওনাকে দেখে। সোহম কোনদিনও বাড়িতে ঢোকেনি, কিন্তু যখনই দরজার বাইরে বা বাজারে দোকানে দেখা হয়েছে অন্ততঃ পাঁচ দশ মিনিট গল্প করেই ছেড়েছেন ছায়া। তবে ওঁর বাড়িতে বেল বাজানো এই প্রথম।
ঘরের ভেতরে খুব আবছা আলো। সোহম এর খারাপ লাগলো এটা ভেবে, ছায়াকাকিমা হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। যদিও ভদ্রমহিলা বলেছিলেন উনি রাত বারোটার আগে ঘুমোন না। মনমোহনকে দিনের শেষ ওষুধ রাত বারোটায় খাইয়ে তবে ওর ছুটি।
ছায়া ভেতর থেকেই সোহমকে বললেন, "আয়, তুই ভেতরে এসে বোস, আমি দিচ্ছি"।
সোহম ভেতরে ঢুকে এলো। ঘরে একটা ফ্যাকাশে হলুদ আলো। ছায়াকাকিমার মুখ অব্দি দেখা যাচ্ছে না এমন সে আলোর জোর। আরেকটা অদ্ভুত ব্যাপার, মেঝে জুড়ে ছড়ানো রয়েছে অনেক রকম জিনিসপত্র, এমনকি একটা ক্রিকেট ব্যাটও দেখলো সোহম।
"ঘর গোছাচ্ছিলে কাকিমা?"
ছায়া রান্নাঘরের দিকে যেতে গিয়ে আটকে গেলেন। একটু হেসে বললেন "না রে বাবা, ও আমার পাগলামি বলতে পারিস"।
"কিসের পাগলামি? বলো না!"
"তোর কাকু যবে থেকে এই মারণ রোগে ভুগছে তবে থেকে আমার খুব ভয় লাগতো জানিস?" ছায়া বললেন। "সর্বক্ষণ মনে হতো যেদিন ও ছেড়ে চলে যাবে সেদিন আমি কি করব? তিনকুলে তো কেউ নেই আমাদের"।
সোহম সেটা আগেই দেখেছে। এই দুমাসে কাউকে ওদের ঘরে আসতে দেখেনি। মনমোহন দরজা খুলে রেখে মাঝে মাঝে বাইরের ঘরের চেয়ারে এসে বসতেন, তাও বোধহয় গত দু সপ্তাহে সেটাও দেখা যায়নি একবারের জন্যেও।
ছায়া বলে চললেন। "তাই যে কাছের মানুষগুলো আগেই আমায় ছেড়ে চলে গেছে, তাদের স্মৃতিজড়ানো এক একটা জিনিস এই চোখের সামনে ফেলে রাখতে লাগলাম। যাতে করে এই চলে যাওয়াটা মানিয়ে নিতে পারি সময় হলে পরে"।
সোহম এর মন খারাপ হয়ে গেলো। সন্ধ্যে থেকে পড়ে পড়ে এমনিতেই মাথা ধরে গেছিলো, তাই বুড়িকে একটু কথা বলে সঙ্গ দিতে ইচ্ছে গেলো।
"ওইটা কি পড়ে আছে? চাইনিজ চেকার?"
ছায়া ফিক করে হেসে বললেন, "হ্যাঁ রে। আমার বাবা ছোটবেলায় খেলনা কিনে দেবার ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। এইটা লুকিয়ে কিনে দিয়েছিল মা। লুকিয়ে চিলেকোঠার ট্রাংক এ ভরে রাখতাম। বিয়ের পরের দিন যখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছি, বাবা এইটা হাতে তুলে দিলো। বলল, মা, বাড়ির প্রাণটা তো নিয়েই যাচ্ছিস, আমার অপরাধবোধটাও নিয়ে যা।" একটু চুপ থেকে ছায়া বললেন, "জানিস? বাবা কোনদিন এত লম্বা কথা বলেননি আমার বা ভাইয়ের সাথে। খুব কড়া শাসন এ থাকতাম আমরা। এই কথার পরে আমার তো দু চোখ ভরা বন্যার জল"।
"তোমার ভাই আছে? এখন কোথায় থাকেন?" সোহম জিজ্ঞাসা করল।
ছায়া কিছুক্ষণ চুপ। তারপরে বললেন "বাবা চলে গেলো বিরানব্বই সালে, মা তার একমাসের মধ্যে ঠুনকো জ্বর এ, বাবলু তো বিয়ে টিয়ে করেনি, জন্ম বাউন্ডুলে, ধর্মতলার কোনো একটা ট্রাভেলস কোম্পানিতে লোকজনদের গ্রূপের সাথে ট্যুর অপারেটর হিসেবে যেতো এদিক ওদিক। মাঝে মাঝে আবার একা একাই বেরিয়ে পড়তো। হাতে কেবল ওই কালো ক্যাম্বিসের ব্যাগটা, ওই যেটা সোফার সামনে পড়ে আছে দেখ। দুহাজার তেরোতে হঠাৎ একদিন এসে বলল, 'দিদি, কেদারনাথ চললাম, একাই, এই ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়েছিলাম বাড়ি থেকে, তারপর মনে হলো হিমালয় এর কোলে স্বয়ং মহাদেব এর বাড়ি যাবো, ব্যাগ কিসের? এটা রাখ তোর কাছে, ফিরে এসে নেবো'খন'!"
ছায়া বলে চললেন, "সে ফেরা আর হলো না জানিস? মেঘ ভেঙে না কিভাবে যেনো বৃষ্টি নামলো কেদারনাথ এ, অনেক লোক তলিয়ে গেলো, ভাই আর ফিরলো না। তোর কাকু ওই খারাপ শরীর নিয়ে অনেকবার এ অফিস ও অফিস করেছেন খোঁজ মিলবার আশায়। জামাইবাবু খুব ভালোবাসতো তার উড়নচন্ডী সংসার না করা শালাকে। কিন্তু বাবলু আর ফিরলো না।"
সোহম এর মন আরো খারাপ হয়ে গেলো। কিন্তু ছেড়ে উঠে আসতেও মন দিলো না। নিতান্তই কথা চালিয়ে যেতে জিজ্ঞাসা করলো "আর ওই ব্যাট?"
"ও তো টুবলুর। টুবলু নিচের ফ্ল্যাটে এসেছিল বছর দুয়েক আগে। বছর আটেক বয়স। সারাক্ষণ দেখা হলেই বকবক বকবক। এই ব্যাটটা আমি কিনে দিয়েছিলাম। যদিও ওর সব খেলা ওর বা আমাদের ঘরের মধ্যেই। নীচে যেতে চাইত না খুব একটা। ওর মা'ই জোর করে পাঠাতো যাতে সবার সাথে মিশতে পারে। এইভাবেই এক বিকেলে নীচে খেলতে গিয়ে ফিরলো না ছেলেটা, বল কুড়োতে গিয়ে সোজা গাড়ির তলায়"। শিউরে উঠলেন ছায়া। "ওর বাবা-মা আর থাকেনি এই বাড়িতে, এখনো তালাই লাগানো আছে দেখবি"।
আর বসতে ইচ্ছে গেল না সোহম এর। মনটা ভারী হয়ে গেছে। কাল পরীক্ষা। বললো, "আছছা কাকিমা, পরে আসবো, রাত অনেক হলো, চিনিটা দাও"।
ছায়া দাঁড়িয়েই রইলেন। ঘরের ভেতর থেকে একটু একটু অস্পষ্ট কথাবার্তার শব্দ ভেসে আসছিল অনেকক্ষন। সোহম ভাবছিলো মনমোহন কাউকে ফোন করছেন হয়ত। সেই আওয়াজ আরেকটু যেনো বাড়লো। দুটো গলা? কেউ এসেছে নাকি, যাক গে, ওর কি, সোহম ভাবলো।
ছায়া হাতের আঙ্গুল তুলে ঘরের মেঝেয় পড়ে থাকা একটা চৌকো চ্যাপ্টা জিনিসের দিকে দেখিয়ে সোহমকে জিজ্ঞাসা করলেন, "আর ঐটা কি বল তো?"
সোহমের আর এই খেলাটা ভালো লাগছিলো না। কিছু না বলে সোজা পড়ে থাকা জিনিসটা হাতে তুলে নিলো। দেখলো ওটা মনমোহন আর ছায়ার একটা পুরোনো ছবি, সম্ভবতঃ বিয়ের পরের, ফ্রেম করে রাখা আছে। জিজ্ঞাসু চোখে ছায়ার দিকে তাকাল সোহম, ছায়ার মুখের কাছটা বড্ড অন্ধকার।
ছায়ার গলার স্বর যেন অনেক দূর থেকে ভেসে এলো, "যতই ভেবেছিলাম এই সব করে চলে যাওয়াটা মানিয়ে নেব, পারলাম না রে, তোর কাকু আজ দুপুরে চিরদিনের জন্য চলে গেলেন, চোখে পুরো অন্ধকার নেমে এলো, ঘুমের বড়িগুলো সব একসাথে মুখে পুরে দিলাম, যখন ঘুম ভাঙলো, দেখলাম বাবলু শিয়র এ এসে বসে আছে, তোর কাকুর সাথে জমিয়ে গল্প করছে, এবারে সবাই একসাথে বেরিয়ে যাবো ভাবছি, যদিও তাড়া নেই কারোর, কারণ কোথায় যাবো তো জানা নেই, এমন সময় তুই বেল বাজালি"।
সোহম এর পা আর গলা যেন কেউ বেঁধে রেখেছে, তবুও সর্বশক্তি দিয়ে পেছনে হেঁটে দরজার বাইরে যাবার চেষ্টা করল, অন্ধকারটা যেন আরো বেড়েছে ঘরের মধ্যে, শুধু ছায়াকাকিমার শরীরের আশেপাশে আলোর ছিটে।
বেরিয়ে যেতে যেতে ছায়াকাকিমার গলা শুনলো শেষবারের মতো, অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার আগে, "চিনিটা তো নিয়ে যা বাবা, রান্নাঘরেই পেয়ে যাবি, সামনেই, এত রাত্রে আর ......"!