Saturday, July 6, 2024

ছবি-টবি'র গপ্পো: কিংস অফ দ্য রোড

যুদ্ধোত্তর জার্মানি। পশ্চিম। ব্রুনো। পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির সীমানা অঞ্চলে ভেঙে পড়া, বেশিরভাগ সময় জনবিরল, সিনেমাহল সিনেমাহলে প্রজেকশন যন্ত্র সারাই ও রক্ষণাবেক্ষণ করে বেড়ায়। একটা বড় ক্যারাভ্যান। তাতেই থাকা, শোয়া, খাওয়া, গান শোনা। তাতেই ঠাসা প্রজেকশন যন্ত্রপাতি ও তার সারানোর সাজ-সরঞ্জাম।

রবার্ট। জোরে গাড়ি চালিয়ে এসে ব্রুনোর দাঁড়িয়ে থাকা ক্যারাভ্যান-এর সামনের নদীতে এসে ডুবে যাওয়া গাড়ির চালক। আত্মহত্যার চেষ্টা? বড্ড ফাঁপা আয়োজন যদিও। রবার্ট নিজেকে ডাক্তার বলে দাবি করে, জানায় সদ্য ডিভোর্স-এর মানসিক দ্বন্দ্ব-তেই এই আত্মহননেচ্ছা। জামাকাপড় শুকিয়ে নিয়ে ব্রুনোর ক্যারাভ্যান'এই বেরিয়ে পড়া। উদ্দেশ্যহীন। রবার্ট এর জন্য তো বটেই। ব্রুনোর কাজ? সেও তো কতটা সিনেমার ভালোবাসা আর কতটা জীবনযাত্রার খাতিরে তা তর্কসাপেক্ষ।

কথা কম হয়। রাস্তা কাটে বেশি। বোঝার চেষ্টা একে অপরকে? সেরকম দরকারি নয় দুজনার কাছেই। লড়াই, বিরক্তিও আসে। কিন্তু দুজন হাত বাড়িয়ে শূন্যতার আগে একে অপরকেই পায়, তাই সহ্যও করে নেয়।

আমেরিকান সৈন্যদের ছেড়ে যাওয়া ধূসর যৌনতাধিক্যময় সংস্কৃতি ও সেই আশ্রিত সিনেমা, সেই সিনেমাকে ঘিরে থেকে যাওয়া কিছু অনিচ্ছুক, নির্বোধ রোমান্টিক, পরিস্থিতির যাঁতাকলে পড়া মানুষের দেখা পেতে থাকে ব্রুনো। ব্রুনোর আর বিভিন্ন সিনেমাওয়ালার কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে পরিচালক উইম ওয়েন্ডার সিনেমার ক্ষয়িষ্ণু দর্শনকে এই ভাবেই কুটিকুটি করে হাওয়ায় উড়িয়ে দেন। খারাপ লাগে? নিয়তি কেন বাধ্যতে। বর্তমান সময়ের সাথেও মিল? বড় আর্টিস্ট'রা তো ভবিষ্যৎ-দ্রষ্টা হয়েই থাকেন।

সিনেমা এগিয়ে চলতে থাকলে বোঝা যায় চরিত্রদুটি ওই ভেঙে পড়া অতীতগৌরবের সিনেমার মতই ভাঙা আর ফেলে আসা অনেককিছু বয়ে নিয়ে চলেছে। ব্রুনো ফেলে এসেছে নিজের একাকীত্বের শৈশব। রবার্ট ফেলে এসেছে প্যাট্রিয়ার্ক বাবা ও তাঁর প্রযুক্তির গতির কাছে হেরে যাওয়া প্রাণাধিক প্রিয় প্রিন্টিং প্রেস, নিজের ভাঙা বৈবাহিক সম্পর্ক। দুজনেই দুজনের কেবলমাত্র প্রেজেন্সের সাহসে ভর দিয়ে ঘুরে আসে সেই ফেলে আসা ভয়কে বা স্মৃতিকে। বোঝা যায় দুই-পুরুষ-চরিত্রপ্রধান এই ছবিতে নারী, নারীসঙ্গ, নারী-সম্পর্ক'র অশরীরী ছায়ার অস্তিত্ব। চরিত্রদুটিও বোঝে তাদের পালিয়ে যাওয়ার আর পুরনো ভয় বয়ে চলার মানসিকতার পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তার কথা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা থেকে বেরোতে পারে? না শেষ দৃশ্য ইঙ্গিত দেয় তারা তাদের নিয়তির ও সামগ্রিক মানবচরিত্রের এই ফেলে আসা স্মৃতির মৃতদেহ বয়ে চলার দুর্বলতাকে হয়তো কখনোই ছেড়ে আসতে পারবে না।

উইম ওয়েন্ডার। স্বর্গভ্রষ্ট মর্তবাসী এক সহানুভূতিশীল দেবদুতের আশ্চর্য গল্প নিয়ে প্রথম এসেছিলেন আমার কাছে তার 'উইংস অফ ডিজায়ার'-এ। অনেকদিন আগে। এরপর, সামান্য কিছুদিন আগেই, মুখে এসে ঝাপটা মারে তার 'পারফেক্ট ডেজ'। টোকিও'র হিরায়মা আমার দাবিয়ে রাখা একাকীত্বের লোভটাকে উস্কে দিয়ে যাওয়ার পর দেখে ফেলি 'প্যারিস, টেক্সাস'। এরপর এই 'কিংস অফ দ্য রোড'এ আবার ওয়েন্ডার এর কাছে ফিরে যাওয়া। আসলে এ ফিরে যাওয়া নিজের কাছেই। নিজের ভুলগুলো বা নিজের বয়ে বেড়ানো দুঃস্বপ্ন গুলোর কাছেও।


Friday, August 18, 2023

জেনারেল বডি মিটিং

লাইভভিডিও: হ্যাঁ, ইয়ে, জিবি শুরু করছি তা'লে? ব্যাপারটার নিরপেক্ষতা বোঝাতে ফেসবুক লাইভটাই ভালো হবে বলে মনে হয়।

তৃণক্যাডার: জীবী কিসের হে? বুদ্ধিজীবী? সুবোধ? শহীদ দিবস না? পাগলু ডান্স হবে নে? যুবনেত্রী নাচ্ছে না? মদণ্ডা 'ও লাবলি' বলবেনি? ই কি মাজাকি? শোক করবো কি করে?

তৃণটাক্লুকবি: কেউ না থাক, আমাদের মা, আমাদের দিদি তো আছেন। নাচটা আজ থাক বরং। দুটো লাইন রইল:
"শোকের টিয়া উঠল কেঁ(দে) রোদের তক্তপোষে
মেঘের কালো লাগলো পোঁ(*) তোদের লক্ষবুকে"

তৃণডিলান: নু(*)কুসোনা চু(ঙ)কুমুনু, জিজ্ঞেস করেছিলি তোর বউকে ......

ডেপোছেলে:  বাংলা খেয়াল!

তৃণডিলান: কে রে? তোর বাবা বাংলা খেয়াল বান(*)দ! বাংলা খেয়াল একশোবার হয়, তোর মা'কে জিজ্ঞাসা করিস হারা.ম.জাদা!

স্বাধীন: হাল্লা করবেন না। মার্ক্স বলেছিলেন ......

কোর্টবিকাশ: উঁহু, ওনার একান্ন পার্সেন্ট শেয়ার আলিমুদ্দিন রাখে, মামলা করে দেবো কিন্তু।

নোভোটটু: তাহলে লেনিনের-টা থাক।

তৃণপরিচালক: হ্যাঁ, বুদ্ধবাবু সাকুরভের সিনেমায় লেনিনের পা.ছা দেখে আটকে দিয়েছিলেন!

বাবলুদা: আটকানোর কথা কিছু বলছিলে ভাই? আমি পেলেকে একবার ......

ইনবক্স: দাদা? ও দাদা? .....

ফেবুক্যাওড়া: থাম ভাই। খাসা ক্যাঙ্গারু কোর্ট চলছে, মন ভরছে না? 

জয়েরবাবা: হামার ইস্ক্রিনে নজর রাখছে হামি। উ কোর্ট বোর্ট জাজ ওয়াজ লিয়ে কিছু করার থাকলে ইদিকে বোলিয়েন ....

চোরাধিকারী: নমস্কার স্যার!

আওয়াজ: "চোলায় চোলায় ছুটছে জয়ের পোঁ() ...."

জয়েরবাবা: হাপনি প্র্যাকটিস-টা একটু ওদিকে সরে করিয়েন, আর হামার ছেলে হাপনার কোন পাকা ধানে মই দিলো যে আপনি তার পোঁ() ধরে টানাটানি করছেন?

চোরাধিকারী: নমস্কার স্যার! দিলীপের দ্বারা হবে না স্যার! মজুমদার-ও একটা ইডিয়ট। একমাত্র আমিই ....

জয়েরবাবা: তুই থাম। এ মার্কেটে সিসিটিভি বললে লোকে তোর সিসিটিভির সামনে তোলা পুরনো কেসটার স্ট্যাটাস জানতে চাইছে।

চোরাধিকারী: হরেকৃষ্ণ, নেটওয়ার্ক-টা কেটে যাচ্ছে বারবার, কিছু বললেন?

ডুবলুডিলু: হ্যাঁ, মজুমদার তো ইডিয়ট হবেই! তোমরা শা.লা উচ্চবংশজাত চ্যাটার্জি আর চক্রবর্তী নিয়ে মাথায় তুলে নাচতে অভ্যস্ত ...

পাহাড়দত্ত: আমিও কায়েত ছিলাম ভাই। 'গণেশ টকিজ' মৃনাল সেন ঘরানার শেষ সিনেমা, আমি মৃণাল-দাকে ব্রান্ডি খাওয়াতাম, আমি জানি।

লেখকপ্রকাশক: ব্রান্ডি-ফ্যান্ডি না, হুইস্কি খান। আমি খাই। সিঙ্গল মল্ট। নয়তো এই পায়ুমন্থনকারী বাংলা বইবাজারে টিকে থাকা অসম্ভব।

অভিজাতপ্রকাশকগিল্ড: কিছু বলছো?

লেখকপ্রকাশক: না দাদা, আপনারা নমস্য, বাকিদের কথা বলছি।

চোরকুঘোষ: বুদ্ধ-বাবু'র কিছু আপডেট আছে? খিস্তি ছাড়তাম দু একটা।

ইনবক্স: দাদা? ও দাদা? .....

তৃণঘেঁষাপরিচালক: ও তৃণপরিচালক-দা, আমারটা নন্দন চার থেকে নন্দন একে দিয়ে দেবে ভাই? কাল কুড়ি জনের শো পুরো হাউসফুল ছিলো, আমার ভায়রাভাই-এর পুরো ফ্যামিলি এসেছিলো। বাংলা ছবির পাশে লোক একটু দাঁড়াক।

স্বাধীন অথবা নোভোটটু: চোপ! কোথায় ছিলে মরিচ.ঝাঁপির সময়? কোথায় ছিলে বান.তলার সময়? কোথায় ছিলে নন্দী.গ্রামে?

তৃনডিলান: দৃপ্ত পায়ে মশাল জ্বলুক নন্দী.গ্রাম, মমতা.ময়ী'র হাজার দশক নন্দী.গ্রাম ...

ডেপোছেলে: বাংলা খেয়াল ...

তৃণডিলান: তোর বাবা বাংলা খেয়াল ...

ভক্ত: কোথায় ছিলে যখন শ্যামা.প্ৰ খুন হচ্ছিলেন? কোথায় ছিলে যখন বিবেক অগ্নিহোত্রী খুন হন?

বামপরিচালক: দ্বিতীয়জন হননি এখনো, তবে হলে মন্দ হতো না।

মলাট: বিবেক অগ্নিহোত্রী'র পিডিএফ হবে দাদা?

ইনবক্স: দাদা, ও দাদা? ...

ফেবুক্যাওড়া: ইট পেতে বস না ভাই! ফুট কাটিস নে।

স্বাধীন: হাল্লা করবেন না, স্ট্যালিন বলেছিলেন ...

তীব্রবামফোবিক: হ্যাঁ, উনিই তো বলতেন, আর কাউকে বলতে দিতেন বলে তো শুনিনি। বলতে গেলেই গুলাগে পুরে দিতেন।

পরিবর্তনশীল: একটা ব্যোমকেশ, শবর আর মিতিন-মাসি'র ক্রসওভার এর ট্রেলার আছে, এখানে লোকজন আছে, লঞ্চ করবো?

একুশলাখগাড়িঘোষ: আমার ইউটিউব চ্যানেল-এ করুন না দাদা, সর্বহারা ইমেজটায় কেস খেয়ে গেছি, এখন জেন জেড-টাইপ ইমেজটাই ভরসা!

ফুর.ফুরা: আই এস এফে চলে যাবো কিন্তু!

চোরকুঘোষ: তুমি এ মিটিং-এ কি করছো ভাই? তোমাকে না ডেলো যেতে বললাম! এসব হিসেব কি এখানে হয়?

ভেগান: আজকের মিটিং-এ মেনুটা কি আপনাদের? সয়া মিল্ক-এর চা আছে?

ইনবক্স: দাদা, ও দাদা! .....

ফেবুক্যাওড়া: থাম তুই। দিব্যি বাওয়াল হচ্ছে। আনন্দমেলা পূজাবার্ষিকী পড়েছিস? পড় না।

রিভিউয়ার: আনন্দমেলা পূজাবার্ষিকী-কে দশে চার দিলাম।

বিনীতলেখক: ভাই, ঝুমঝুমি'র পুজো-সংখ্যায় আমার এ বছরের ষোল নাম্বার লেখাটা পড়ে একটু লিখে দেবে, শেয়ার করবো?

স্বাধীনপরিচালক: আমি এসব বলবো না। আমার ছবি নন্দন ছয়-এ চলেছে, গতকাল দুপুর পর্যন্ত, আজ জানি না, দেখবার হলে দেখে নেবেন।

ভূতেরদত্ত: নন্দন নিয়ে আর কিছু বলবো না ঠিক করেছি। গেল'বার যা কেস খেয়েছি। এস ভি এফের টাকা ছাড়া এ বাজারে সিনেমা করতে হয় ম'হায়!

স্বাধীন অথবা নোভোটটু: কোথায় ছিলে ভিয়েতনামে, নিকারাগুয়ায়? কোথায় ছিলে গুজরাট-এ?

জয়েরবাবা: গুজরাট শুনলাম, হামি দেখছে কিন্তু এখনো...

আওয়াজ: "আমার গাঁ()র ভেলা চোলছে মেলা ...."

জয়েরবাবা: ধুর মোশায়, তখন থেকে বলছি, ওদিকে গিয়ে করুন না প্র্যাকটিস।

ইনবক্স: ও দাদা? বলছি আমি তো বাঁচতে চেয়েছিলাম!

ফেবুক্যাওড়া: সে তো বেণু-দিও চেয়েছিলো, পরে তোমাদের দাদা তোমাদের দাদা বলে রান্নাঘর চালাতো।

অতিরঞ্জন: একটু দেরি হয়ে গেলো। সেই যে রবীন্দ্রনাথের চাপা কাম এর বহিঃপ্রকাশ, ব্যদলেয়ার এর বই বুকে চেপে আমার জন্য সুচিত্রার কামনা ....

গৌতমদা: ওনার শেষ ইন্টারভিউ-টা আমার কাছেই আছে কিন্তু!

রোববারসম্পাদক: সে যাই বলুন, আমার বাঁধা বাবু টুটুর নাতি'ই এখন সেরা ইন্টারভিউয়ার ...

নীতু: বাঃ, টাকা দুজনে নিলাম, জেলে দুজনে গেলাম, আর কেউ 'আমার রক্তে ইষ্টবেঙ্গল' বলছে না, কেবল টুটু টুটু ...

স্বাধীন / নোভোটটু / বাম: সে যাই হোক, সিসিটিভি নিয়ে আজকের এই যে জি বি ...

ভক্ত: সিসিটিভি লাগবেই। এবি.ভিপি আসবেই। সিসিটিভি না লাগলে আমাদের এমপি লোকসভায় কি ক্লিপিং দেখবে?

ইনবক্স: ওহ, এটা সিসিটিভি নিয়ে? আমি ভেবেছিলাম আমার মারা যাওয়া-টা.....। আছছা, ঠিক আছে, আসি দাদা!

ফেবুক্যাওড়া: আরে দাঁড়া না ভাই। আরে ও ভাই। ধুত্তোর।

(লাইভ এর আলো নিভে আসে)

Sunday, April 9, 2023

ছবি-টবি'র গপ্পো: নানপাকাল নেরাথু মায়াককম

লিজো জোস পেলিসেরি। ভারতের হাতে গোনা চূড়ান্ত প্রতিভাবান নিউ এজ পরিচালকের একজন। "ই মা ইউ" নামের একটা মাল্যালম ছবির মাধ্যমে তার কাজের সাথে আমার প্রথম পরিচয়। চৈতন্য তামানে বা আচল মিশরা'র মতই হতবাক করে দেওয়া ছিলো সেই প্রথম দর্শন।

মামুটি। যখন ইন্টারনেট ছিলো সর্বাধিক বাহান্ন কেবিপিএস-এর, আঞ্চলিক সিনেমার সাবটাইটেল দুরদর্শন-এর রোব্বার দুপুরের ছবি ছাড়া পাওয়া ছিলো দুর্লভ, সেই সময়ে অগুনতি হিন্দি ছবি দেখা ছাড়াও কেবল টিভিতে আরেকটা নেশা পেয়ে বসেছিলো আমাকে। এশিয়ানেট টিভি। মাল্যালম সিনেমা। মামুটি আর মোহনলাল। ভাষার দুরলঙ্ঘ দূরত্ব সত্ত্বেও। আজ এই সত্তরোর্ধ বয়সেও দুজনেই নিজেকে ভাঙছেন, গড়ছেন। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই ভারতবর্ষের সর্বকালের সেরা দশ নায়ক অভিনেতা'র দুজন একই রাজ্যের বাসিন্দা।

নানপাকাল নেরাথু মায়াককম। নেটফ্লিক্স এ আছে। লিজো আর মামুক্কা'র যুগলবন্দী। অবশ্য থেনি ঈশ্বর এর ক্যামেরা আর সম্পূর্ণ সাউন্ড ডিজাইনিং টিমকে একটুকুও কম প্রাধান্য দেওয়া যাবে না। সে অর্থে কোনো কলাকুশলীকেই নয় অবশ্য। নামের আক্ষরিক অর্থ "দুপুরের একটি ঘুম", লিজো ইংরেজি সাবটাইটেল এ নাম রেখেছেন "লাইক য়্যান আফটারনুন ড্রিম"।

জেমস। মাল্যালি। রুক্ষ। ভগবৎ প্রসঙ্গে উদাসীন। পরিবারকে ভালোবাসে। তামিল খাবারদাবার বা লোকজন বিশেষ পছন্দ করে না। স্ত্রী আর বছর বারোর ছেলে। সম্ভবতঃ একটি ধর্মীয় নাটক-গানের দল নিয়ে তামিলনাড়ুর একটি চার্চে যায় নিজেদের গ্রাম থেকে, নিজেদের জন্য একটি বাস ভাড়া করে। জেমস'ই দলের ম্যানেজার বিশেষ। দলের সবাই ফেলে এসেছে কেরালায় নিজেদের দৈনন্দিন কাজকর্ম বা ব্যবসা, সবার মধ্যে ফেরবার তাড়া।

সুন্দরম। তামিলনাড়ুর এক ছোট গ্রামের বাসিন্দা। বাড়িতে স্ত্রী, মেয়ে - সম্ভবতঃ ওই বছর বারোর, অন্ধ মা, বাবা, ভাই। সামান্য চাষবাস আর গরুর দুধ বিক্রি। বছর দুয়েক আগে ক্ষেতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। থানা, পুলিশ। খোঁজ পাওয়া যায় নি আর।

জেমসের দল ফিরছে বাস নিয়ে। ক্লান্তি, নেশার ঘোর, সব মিলিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে সবাই। জেমস হঠাত এক প্রত্যন্ত গ্রামের ক্ষেতের মাঝে থামাতে বলে বাস। হাঁটতে থাকে। এটা সুন্দরমের গ্রাম। মনে হয় জেমসের কতদিনের চেনা। সুন্দরমের বাড়িতে এসে থামে। গরুটাকে খড় দেয়, বাড়ির লোক খড় পর্যাপ্ত দেয়নি বলে গজগজ করে। মাল্যালি-দের সাদা মুন্ডু (ধুতি) ছেড়ে পরে ফেলে বাইরে টাঙানো তামিল লুঙ্গী। বাড়িতে ঢুকে আসে। সুন্দরমের অন্ধ মা, যিনি সারাদিন একটা থামে হেলান দিয়ে একটার পর একটা তামিল সিনেমা দেখে(শুনে) চলেন, তাকে অদ্ভুতভাবে দেখা যায় জেমসের সাথে অনায়াসে কথাবার্তা বলতে, যেন ছেলে সুন্দরম, দুপুরে, দুবছর আগের অন্য যে কোনো দিনের মতোই বাড়ি ফিরে এসেছে। জেমস রান্নাঘরে ঢুকে আসে সুন্দরমের স্ত্রী এর ঘরের মধ্যে দিয়ে, কফি বানাতে গিয়ে রান্নাঘরের জিনিস কম হয়ে আসা নিয়ে অনুযোগ করে স্ত্রীকে, ওই অনায়াস ভঙ্গীতেই, যেন অবিকল সুন্দরম। সুন্দরমের স্ত্রী আর বাবা হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন, বারণ করতে পারেন না। আর সুন্দরমের মা আর জেমস তো সর্বক্ষণ একে অন্যের সাথে চূড়ান্ত স্বাভাবিক। জেমস সুন্দরমের বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ক্ষেতের দিকে। বাবা-হারা সুন্দরমের মেয়ে বাড়ি ফিরে মা'কে আর বাড়ির সবাইকে বকাবকি করে। সুন্দরমের ভাই, দাদা হারিয়ে যাওয়ার পরে পরিবারের দায়িত্ব নেওয়া ভাই, হয়তো আরো বড় দায়িত্ব নেবে শিগগিরই, সম্ভবতঃ দূরে কোথাও সেইদিন, ফোনে রাগ দেখায় এক প্রতারককে ঘরে ঢুকে এতকিছু করার সুযোগ দেওয়ার জন্য।

শুরু হয় এক লড়াই। জেমসের দলের লোকজন, তার স্ত্রী পুত্র শ্বশুর মিলিয়ে জেমসের এই পরিবর্তন দেখে হতবাক হয়ে যায়। সামনাসামনি দেখা হলে, যা অনেকের সাথেই অনেকবার হয়, জেমস প্রত্যেককে চিনতে অস্বীকার করে। দলের লোকজন এমনকি ভাবতে থাকে পরেরদিন ঘুমের ওষুধ দিয়ে জেমসকে তুলে নিয়ে যাওয়ার কথাও। গ্রামের লোকেরাও সমস্ত ঘটনাপ্রবাহে হতবাক। রাত্রের মতো থাকার জায়গা আর খাবার এর জোগাড় করে দেয় বাসের লোকজনকে। কিন্তু গ্রামের লোক বা সুন্দরমের বাড়ির লোক কোনোভাবেই জোর করে দূরে সরিয়ে দিতে পারেনা দুবছর বাদে জেমস-এর শরীরে বাড়ি ফিরে আসা সুন্দরমের ভাবনাটাকে। বিশেষতঃ সুন্দরমের স্ত্রী ও বাবা তো নিজেদের পুরোনো রুটিনে পরম মমতায় জায়গা দিতে থাকেন জেমস  অথবা সুন্দরমকে।

গল্পের পূর্ণাঙ্গ বয়ান যেকোনো সিনেমার আলোচনায় ক্ষতিকারক। একজন লোকও যদি সেই আলোচনা পড়ে ছবি দেখতে যান, তবে ছবির টানটান ভাবটা, ছবির নিজের খেয়ালে গল্পের খোলস ছাড়ানোর আনন্দটা চলে যায় তাতে। তাই এইটুকুই রইল গল্পের। পরাবাস্তব যদি আপনার পছন্দ না হয়, সিনেমার শেষে যদি শুধু একটাই সিদ্ধান্ত নিতে পছন্দ আপনার, দেখবেন না এই ছবি। রজারএবার্টডটকম এই ছবিকে তাদের সর্বোচ্চ রেটিং এর একটা দিয়েছে, ফেলিনি-কে টেনে এনেছে দৃশ্যকল্প'র তুলনায়, ভারতীয় হিসেবে গর্ব হবে কিনা ভেবে দেখা আপনার কাজ।

সিনেমার আত্মাটা কিন্তু লিজো'র রাখা ক্যামেরার মতোই স্ট্যাটিক। লংশটের ব্যবধানে রাখা আপনার থেকে। আপনার জীবনের মতোই তার ব্যাকগ্রাউন্ড-এ প্রচুর সিনেমা আর গান-এর, অর্থাৎ দুনিয়ার বিভিন্ন মায়া'র আওয়াজ ভেসে আসা। সিনেমার মায়া, সুন্দরমের গ্রামের এক দুপুর থেকে পরের দিনের দুপুরের মায়া, এতো মায়ার খেলা আপনাকে নিয়ে যেতেই পারে নিজের অস্তিত্বর মায়াকে নিয়ে প্রশ্ন করবার অবস্থায়। শেষ শটে পুরোনো তামিল সিনেমার অতিনাটকীয় গানের লিরিকে প্রশ্ন ওঠে, শেষ দিনে স্ত্রী রাস্তা অব্দি আপনাকে সঙ্গ দেবেন, ছেলে চিতা অব্দি, কিন্তু অখণ্ডে মিশে যাওয়া পর্যন্ত কে ধরবে হাত? পরিচালকের মর্জি অনুযায়ী'ই আপনার ভাবনাও জেমস ও সুন্দরম এবং তাদের পরিবারের সাথে ভাবনায় ব্যস্ত থাকে, কারণ সবাই এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছে সিনেমার পর্দায় বা তাদের জীবনের একটা দিনে।

Sunday, August 14, 2022

গোরা

কাকতালীয়ভাবে, যেদিন রুশদিকে প্রায় বিশ-বার ফালাফালা করছে ধর্মের ছুরি, সেদিনই, স্টোরিটেল য়্যাপে সাড়ে বাইশ ঘন্টার অডিওবুক ম্যারাথনে শেষ হলো 'গোরা'। জীবনে দ্বিতীয়বার। 

একটু বিষয় থেকে সরে যাই। সম্প্রতি, দি ওয়ার্স্ট পার্সন ইন দি ওয়ার্ল্ড নামক একটা নরউইজিয়ান ছবিতে খুব সুন্দর করে বর্তমান পৃথিবীর চল্লিশের ঘরের ও কুড়ির ঘরের লোকেদের প্রাথমিক ডিলেমাটা বলা হয়েছে। প্রথমটা এখানে প্রাসঙ্গিক। চল্লিশের ঘরের যখন লোকজন একটা নতুন পৃথিবীতে বেড়ে উঠেছিলো, তখন কোনো একটা বিশেষ সামাজিক বা রাজনৈতিক বোধকে কোনো বিশেষ বিশেষ লেখক, শিল্পী, বই, সিনেমা বা মুভমেন্ট দিয়ে সন্তর্পণে খাইয়ে দেওয়া হয়েছিলো। যেটার ভালো আর খারাপ দুটো দিকই ছিলো, কিন্তু একটা কথা একেবারে খাঁটি, তাদের বৈচিত্র্যর বা বিপরীতের সঙ্গে একসাথে বেড়ে ওঠার ক্ষমতা থেকে অনেকটা দূরে সরিয়ে দিয়েছিলো, যার ফল আজকের সময়ে এসে তাদেরকে ভুগতে হচ্ছে।

জীবনে প্রথমবার 'গোরা', 'চার অধ্যায়' আর 'ঘরে বাইরে' পড়া - আমার ব্যক্তিগত রাজনৈতিক আর ধর্মীয় অস্তিত্বটা গড়ে তুলেছিল, যা আজ অব্দি একটুও টসকায় নি, শুধুমাত্র বহিরজগৎ এর চরম বৈপরীত্য সহ্য করতে না পেরে মৌনতা অবলম্বন করতে বাধ্য করেছে।

এই দ্বিতীয়বার এর গোরাপঠন (বা, শ্রবণ) সেই বোধটাকে দৃঢ়ই করলো আরো। এখানেই বাংলার প্রিয় শোকেস-বন্দী ঠাকুরের জয়। সমসাময়িকতা। হতে পারে সাকুল্যে কুড়িটি কবিতা, বাজারচলতি পঞ্চাশটি গান, ব্যক্তিপূজা, বা ব্যক্তিচরিত্রের কালিমালেপনের বাইরে তাকে চিনতে পারার পরিসর কমেই এসেছে, কিন্তু তিনি থাকবেন, অল্প কিছু লোকের মধ্যে হলেও, আবিষ্কার ও পুনরাবিষ্কার এর মধ্য দিয়ে।

প্রাচীন ধর্ম প্রাসঙ্গিক, কিন্তু তার পচন থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখা মূর্খতা। পরিবর্তন প্রাসঙ্গিক, কিন্তু পরিবর্তন এর ঝান্ডা ধরে মূল ও দ্বন্দ্বকে অস্বীকার করা অন্যায়। ধর্মের মোড়লদের দূরে সরিয়ে রাখা কতটা জরুরি, ঠিক যতটা জরুরি ধর্মের দর্শনটাকে নিজের মনের গবেষনাগারে পরীক্ষা করে নির্যাসটুকু তুলে নেওয়া। দুর্বল ও অবহেলিতদের পাশে দাঁড়ানো ততটাই জরুরি, ঠিক যতটা জরুরি ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে তাদের বদলে যাবার পর তাদের উত্তরণের ইতিহাসকে মনে করিয়ে দেওয়া। সমাজপরিবর্তনের ঠিকাদারদের নির্বোধ ভক্তরা ঠিক কতটা অপাংক্তেয়। সবথেকে বড় সত্য হলো আপেক্ষিকতা, আর সত্য নিজে। তাদের পাওয়ার একমাত্র রাস্তা হলো আত্মপর্যালোচনা। গোরা আবার শেখালো। এবং শিখিয়েও মনে করিয়ে দিলো এগুলোই ধ্রুবসত্য বলে দাগিয়ে রাখবার কোনো উপায় নেই, কালের কষ্টিপাথরে যাচাই করে যেতে হবে, প্রতিনিয়ত।

উপন্যাস হিসেবে? মন্তব্য করবার উপায় নেই। পড়াশোনার পরিধি সেই অবকাশ দেয় না। বঙ্কিমগদ্যভাষাকে তরল করে ফেলে এর জোর ও স্বাতন্ত্র্যকে খর্ব করার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন ঔপন্যাসিক বিভিন্ন সময়ে (আমি যাদের শুনেছি - নবারুণ, সন্দীপন)। কিন্তু সে আলোচনা সাজবে তাদের যারা প্রতিনিয়ত এই তুলনামূলক সাহিত্যবিচারে মগ্ন আছেন।

Tuesday, June 14, 2022

আত্মঘাতী বাঙালি


আমরা যারা ছোটবেলায় মফস্বল থেকে কৈশোরান্তে বিভিন্ন পরীক্ষা-টরীক্ষা দিতে রবিবার ভোরের ট্রেন ধরে সকাল আটটার মধ্যে হাওড়ায় এসে নামতাম, তাদের কাছে দ্বিতীয় লক্ষ্য হতো সকাল দশটা বা এগারোটার মধ্যে কলকাতার নির্দিষ্ট পরীক্ষাকেন্দ্রে উপস্থিত হওয়া। আগে থেকে বাবা-কাকাদের পরামর্শ না নেওয়া থাকলে, ট্রেনে যে সব কাকুরা ডেলিপ্যাসেঞ্জারি করতেন, আনন্দবাজার 'কিনে' পড়তেন, মোটা কালো ফ্রেমের চশমা পরতেন, চেককাটা জামা ইন করে পরতেন না, তাদেরকে জিজ্ঞাসা করতে হতো প্রথম কোন বাসটা ধরে গন্তব্যর সবচেয়ে কাছাকাছি পৌঁছাতে পারবো। যে কোনো কাউকেই জিজ্ঞাসা করা যেতো, কিন্তু এদের এফেক্টিভনেস ছিলো অনবদ্য। একটা "এহ, পোলাপান" গোছের নজর দিয়ে নিজের জ্ঞান কম থাকলেও নিজের ডেলিপ্যাসেঞ্জারি  ব্যাটালিয়নকে দিয়ে টিমওয়ার্ক করিয়ে কোন সাবওয়ে দিয়ে বেরিয়ে সরকারি লাল বা ধুসরবাস বা বেসরকারি নীলবাস ধরতে হবে জানিয়ে তাদের গতি, ভাড়া, এবং গন্তব্যস্থলের য়্যাকিউরেসির ওপর একটা কম্পারেটিভ স্টাডি ঝপ করে ফেলে দিতে পারতেন। অথবা, "এই দাসবাবু, একে আপনার রুটে ঝাঁপতলা পেরলে যে স্টপেজটায় ঘোষের শ্বশুরবাড়ি ছিলো ওটায় নামিয়ে দেবেন তো" মার্কা জ্যাকপট অফার-ও থাকতো কখনোসখনো।


স্টপেজ এ নেমে উদ্দেশ্য থাকতো শেষ লক্ষ্যভেদ। বেশিরভাগ পরীক্ষাকেন্দ্রই হতো উত্তর, মধ্য, বা সদ্য দক্ষিণ কলকাতা শুরু হওয়া এলাকা ঘেঁষা স্কুলে। এবং খুব কম বাসের রুট হাওড়া থেকে সরাসরি পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছে দিতে পারতো। এক্ষেত্রে, এই দ্বিতীয় খেপে, মসিহার ভূমিকায় নামতেন যে সমস্ত পাড়ার কাকুরা, তারা রবিবার সকালে পরনে পরতেন নীল বা বাদামি চেক লুঙ্গি, গায়ে ফতুয়া বা একটা পাতলা সুতির শার্ট, ওপরের দুটো বোতাম খোলা থাকতো, বাঁ কব্জিতে একটা এইচ এম টি'র ঘড়ি, পায়ে চপ্পল, ডানহাতে বাজারের একাধিক বিভিন্ন বহরের ব্যাগ, আর ডানহাতে রোল করে পাকানো য়্যাটলিস্ট দুখানা সংবাদপত্র। সংখ্যাতত্ত্বের বিচারে, সেসময়, শারজায় পাকিস্তানের কাছে ভারতের হারার স্পেকুলেশনের থেকেও সফলতার বেশি সম্ভাব্যতা থাকতো এই সমস্ত কাকুদের পাখিপড়া করে বোঝানো রুটের হদিশে। মনে করিয়ে দেওয়া ভালো, এরা দুটি রুট বলতেন, একটি হতো অন্য একটা বাসে করে শেষ গন্তব্যে যাওয়ার, অপরটি, পায়ে হেঁটে, কিন্তু শর্টকাট। যদিও তাঁদের চোখে লেগে থাকা "তোমাদের বয়সে" চাওনি পরিষ্কার বুঝিয়ে দিতো অপশন যতই দুটো দিন না কেনো, আমাদের হাঁটা-টাই তারা প্রেফার করবেন। 


আমরা কলকাতা এরকম করে চিনেছি। ধীরে ধীরে। নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে না হলেও, বছর ষোলো ধরে। কলেজস্ট্রিট এর পুরনো বই, উত্তর কলকাতার গলি থেকে লঞ্চঘাট, চাঁদনীর সস্তা ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম, লেনিন সরণির পুরনো গ্রামোফোন রেকর্ড, ধর্মতলার নিষিদ্ধ মাংসের কাবাব পরোটা কম্বো, চাঙওয়ার পর্দাঢাকা কেবিন, খিদিরপুর ফ্যান্সি মার্কেটের লজঝড়ে বিদেশিয়ানা, মেট্রোগলির বিল ছাড়া ক্যামেরা আর শ-ব্রাদার্স এর আদা ছোলা, পার্কস্ট্রিট মিউজিক ওয়ার্ল্ড আর ধর্মতলার সিমফনির ক্যাসেট থেকে সিডিতে উত্তরণ, মেডিক্যালের পাশের ফিনাইলের গন্ধ, ট্রামের টং টং, হলুদ ট্যাক্সির সামান্য বাবুয়ানা, এমব্যাসির সিংগিং বার, রাস্তার সস্তা টাটকা খাবার, সাবার্বানের ট্রেনের টাইমটেবিল, গ্র্যান্ডের ফুটপাথের সস্তা ঘড়ি আর টি-শার্টের শখপুরনে, ম্যাগাজিনের বৈচিত্র্যে, বইমেলার ধুলো, ময়দানি আড্ডা, আর অন্তহীন হেঁটে ঘুরে বেড়ানোয়। আরো অনেক কিছু, হ্যাঁ, তবে, আমাদের মত মফস্বলের পেটে খিদে মুখে লাজ ফুটো পকেট উঠতি কালচারসঙ্গমেচ্ছুরা নন্দন রবীন্দ্রসদন বা য়্যাকাডেমি অব্দি পৌঁছাতে পারতো না বললেই চলে।


নিন্দুকেরা বলে থাকেন, প্রেম এমন একটি ওভাররেটেড কন্ট্রাক্ট রিলেশনশিপ, যার শুরু বাদী এবং বিবাদীপক্ষ করে এমন সব টেকনো-কমার্শিয়াল টার্মস দিয়ে যা দুপক্ষের কাছেই বেশ গ্রহণযোগ্য এবং আয়ত্ত্বের মধ্যে, বাকি কনফ্লিক্ট এর জায়গাগুলো থাকে ভদ্রতার মুখোশে চোরাগোপ্তা লুকিয়ে। কিন্তু বিধাতার অথবা প্রকৃতির রাজ্যের মূলে রয়েছে ডারউইনবাদ, যা বলে যোগ্যতমের লড়ে জিতবার কথা অথবা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বিবর্তন এর কথা। প্রেমিকযুগল প্রকৃতির নিয়মের চেয়ে সহজ টার্ফ-এ খেলতে নেমে লড়াই ভোলেন এবং শিকার হন হ্যালুসিনেশনের। অতএব প্রগাঢ় হয় প্রেম। আসে আরো একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত সত্যিকারের পারস্পেক্টিভ বিন্দুমাত্র বিবেচনা না করে। যথানিয়মে, ভুল ভাঙে, কিন্তু সে মুহূর্তে দু পক্ষই হারিয়েছে লড়ে নিজস্ব ব্যক্তিগত পরিসর তৈরির ক্ষমতা, অতএব পড়ে থাকে সন্দেহ ঘৃণা বিরক্তির মত ঋণাত্মক যুগ্ম কিছু মানসিক বোঝা, সারাজীবন বয়ে বেড়ানোর। কলকাতার সাথে আমার প্রেম সেরকমই ছিলো। বাইরে থেকে মোটা কালো চশমা বা নীল লুঙ্গির দরাজমনা লোকজনের বাইরে আরেকটা দুনিয়া ছিলো চোখেই পড়েনি তা। সেই দুনিয়ার লোকেরা খাঁটি অথচ ওভাররেটেড ভ্রান্ত রাজনীতির হাতে একসময় হারিয়েছে যৌবন। পরবর্তী সময়ে সেই রাজনীতির শাখা প্রশাখায় ঢুকে হারিয়েছে পথ। কেউ শুরুতে ভাগচাষী থেকে জমির মালিকানা হাতে পেয়ে শেষে জমিদার হতে গিয়ে খেয়েছে ঠোক্কর। কেউ চাকরি পেয়েছে, সালাম ঠুকেছে, তারপর আয়নার সামনে নিজের ভিখিরিপনা দেখতে পেয়ে নিজের মুখে থুতু দিয়েছে। কেউ পতাকা ধরে মালিকের শোষণ থেকে বাঁচবার পর কাজ করে নিজের কাজের জায়গাটাকে কাজ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার কর্তব্যটাই বেমালুম ভুলে গেছে। কেউ দু-আনার কলম বা মাইক বা ক্যামেরা ধরে সরকারপক্ষের ও প্রতিষ্ঠানের পিঠচাপড়ানি কুড়িয়েছে ঝুঁকে, কেউ কলম আর শিরদাঁড়া বাঁকাতে চাইনি বলে পড়ে থাকতে বাধ্য হয়েছে তৃতীয় শ্রেণীর শিল্পের অন্ধকার গর্তে পুঞ্জীভূত ঘৃণা বুকে ধরে। শাসকের মুখ বদল হয়েছে কিন্তু শাসনকাঠামোর রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে যাওয়া অহং আর ঔদ্ধত্য মৌরসিপাট্টা গেড়েছে।


হচ্চিলো কথা প্রেমের। আমার ও কলকাতার প্রেম এতটাই জমাট বেঁধেছিলো যে আমি নবরত্ন কোম্পানির বেশ শাঁসালো চাকরি ছেড়ে কলকাতায় একটি তৃতীয় শ্রেণীর বিজনেস স্কুলে পড়বার ঝুঁকি নেই এই ভেবে যে পড়াশোনার শেষে কষ্ট করে হলেও আমার প্রিয়তমা শহরের বুকে থাকবার জায়গা মিলবে। সে লক্ষ্য পূরণ-ও হয়। কিন্তু সে হ্যালুসিনেশন ভাঙতে ছ-বছরের বেশি সময় লাগেনা। মোটামুটি মন, আত্মসম্মান ও আত্মনির্ভরতা-শূন্য হয়ে আমি আমার কলকাতাবাস দ্বিতীয়বার এবং সম্ভবতঃ শেষবার এর মতো সমাপ্ত করি। ইতিমধ্যে শাসক বদল হয়েছে। শাসক নির্বাচিত করবার হাত বা মন যেহেতু বদলায় নি, তাই পরিবর্তন এর নামে একটি অশ্বডিম্ব প্রসব হয়েছে। গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরবার অলীক বিপলব থেকে সংসদীয় সমাজতন্ত্র নামক সোনার পাথরবাটি পেরিয়ে শেষপাতে এসেছেন বিপলবের আসল মা যার চেয়ার মুছতে গিয়ে বেতনভুক অকর্মা লুম্পেন, ভিখারি কবি অথবা সহি অতিবামপন্থী ছেলেরা কখনো ভিজিয়ে ফেলছে চোখ, কখনো কখনো রক্তে মাটি অথবা ঢেকে ফেলছে পোড়া ছাই এ শরীর। সময়ের সাথে সাথে বঙ্গনাট্যশালার অলীক কুনাট্যে বীতশ্রদ্ধ হয়ে মোটামুটি ভদ্রস্থ সন্তানেরা যেহেতু আজ তিরিশ বছর ধরে মাইগ্রেশন করে চলেছে, তার জায়গা নিয়ে চলেছে কোথাও যাবার ক্ষমতা ও গুণ না থাকা পেটি বুর্জোয়ারা। তারাও প্রেমে পড়ছে, কলকাতার, কিন্তু সেটা নিজের উপার্জনক্ষমতার বাইরে দাদা-দিদির ছুঁড়ে দেওয়া পয়সার অনুগ্রহে, কাজে ফাঁকি দেবার মোহে, সরকারি দয়াদক্ষিণ্যের হাতছানিতে। তাই পঞ্চাশবছর বাদেও কিছুতেই নামছে না নেমে আসার গ্রাফ। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত দুনিয়া জুড়ে অতি দক্ষিণপন্থী শক্তির বাড়াবাড়ি এসেছে, মড়ক এসেছে আর ভারতের পুরোনো বহু ক্ষতবিক্ষত ফেব্রিক এ নতুন করে রক্ত নিয়ে হোলি খেলতে নেমে এসেছে সঙ্ঘপরিবার ও তাদের মুখোশ, যাদের হাত প্রতিদিন আরো শক্ত হয়ে চলেছে।


এ সলিলকির সাথে বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই, তবুও ঘাড় ঝুঁকিয়ে মেনে নেবার ও রসাতলে যাবার গল্প যখন হচ্ছে - গত একত্রিশে মে, দুহাজার বাইশে, কলকাতায়, প্রখ্যাত গায়ক কেকে তার অনুষ্ঠান শেষ করে মারা যান। একটি মত বলছে, আড়াই হাজার মানুষের সভাগৃহে ছিলো আট-হাজারী ভিড়, যার দরুণ এসি বিকল হয় অথবা বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং গায়ক শারীরিক অস্বাচ্ছন্দ্য উপেক্ষা করে নিজেকে মৃত্যুর দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে বাধ্য হন। এই একই সর্বভারতীয় গায়ককে, বাংলার আরেক গায়ক ড়ুপঙ্কর (বানানভুল ইচ্ছাকৃত) তার আগেরদিনই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করায় প্রাণঘাতী খাপ বসে, বাঙালি গায়ক জানান তিনি কেবলমাত্র বাংলা গানের পাশে থাকবার কথা বলতে গিয়ে, অর্থাৎ গুনগত মানের কথা না বলে একটি কোটারির ভিক্ষা করতে গিয়ে কাকতালীয়ভাবে ঘটি হারিয়ে ফেলেছেন। মজার কথা হোলো, একটু ভেবে দেখলে, আমার ব্যক্তিগত ধারণা, এই একই অপরাধ দিব্যি সংগঠিত ভাবে সংঘটিত হয়েছে বর্তমান সময়ে কোনোরকম উচ্চবাচ্য  ছাড়াই। সরকার, য়্যাপট্যাক্সিচালক ও য়্যাপট্যাক্সিপারেটররা ত্রিমুখী বোঝাপড়ায় গত দুবছর ধরে শতকের সবথেকে কঠিন সময়ে দ্বিগুণ দরে তোলা আদায় করেছেন, সাধারণ মানুষকে অসহনীয় কষ্ট দিয়েছেন গাড়ির এসি বন্ধ রেখে, লাভ তুলেছেন ও ভোটব্যাংক এবং চাঁদা অক্ষুণ্ন রেখেছেন - আমার ধারণা বেশ কিছু লোক এই চক্করবাজিতে পটল-ও তুলেছেন, নেহাত গায়ক কেকে না হবার কারণে মৃত্যুপরবর্তী প্রচার পাননি এই যা। মোটকথা এই যে 'তোমাকে কাজ করতে দেব না' বা 'তোমার থেকে পয়সা নিয়ে মুখের ওপর বলবো পরিষেবা একটি মিথ অতএব যা পাচ্ছো তাই নিয়ে ঘর বাঁধো', এইটে বেশ হাড়ে মজ্জায় ঢুকে গেছে এই বাংলায়। শেষ দুটো টার্ম এর চন্দনের বাবা ব্যারিস্টার বসু থেকে অনুপ্রেরণাদাত্রী ঝপাংকবি, সবাই এই কালচার আনা, দুধ কলা ক্যাডার দিয়ে তাকে পোষা, ও তার বাড়বৃদ্ধিতে সাহায্য করেছেন এবং শেষমেশ সোনার ভোটের ফসল ঘরে তুলেছেন। মাঝখানে বুদ্ধদেব সামান্য বেগড়বাঁই করতে চেয়েছিলেন ডু-ইট-নাও বা শিল্প-টিল্পর মত অস্পৃশ্য শব্দ উচ্চারণ করে, কিন্তু তার নিজের ও দলের সুখের পায়রা কর্মীদের ঔদ্ধত্য সামলাতে না পেরে সমূলে উৎপাটিত হয়েছেন। 


এই এলোমেলো লেখা শুরু করেছিলাম কলকাতার বুকে একের পর এক হওয়া আত্মহত্যার নিরিখে। মনে হয়েছিল যে বাঙালি গত প্রায় তিরিশবছর ধরে দিব্যি খোশমেজাজে চপমুড়ি বিরিয়ানি প্যাঁদাতে প্যাঁদাতে সামাজিক আত্মহত্যা করে আসছে তার হঠাৎ দু-চারখানা জলজ্যান্ত আত্মহত্যাতে এত দুঃখ উথলে উঠছে কেনো। তারপরে খেয়াল করে দেখলাম ক্লিকবেট খবর দেখে বাঙালির মন বোঝার চেষ্টার বড় ভুল করে ফেলেছি, ব্যাপারটা অতটাও সিরিয়াস নয়। বাজারে যে মাছওলা কেজিতে পঞ্চাশটাকা বেশীতে সবথেকে খারাপ মাছটা বেচে আপনাকে, তার কারণ আপনি তার থেকে নিয়মিত জিনিস নেন - আপনার ব্যাংকের যে রিলেশনশিপ ম্যানেজারটি আপনার দুটো লোন করিয়ে দিয়ে নিজের টার্গেট ছোঁয়ার পর সেই লোন এর ইমোশনাল কুমিরছানা দেখিয়ে আপনাকে দুটো পয়সা জলে দেওয়া স্কিম করতে বাধ্য করে - আপনার বাসের যে কন্ডাক্টরটি সময় বাঁচানোর জন্য প্রায় চলন্ত বাস থেকে শিশু বৃদ্ধ মহিলাদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দেয় - যে বাঙালি ব্যবসায়ীটি আপনার সমস্ত ভরসার জলাঞ্জলি কেবলমাত্র নিজের আলস্য আর লোভের কারণে দিয়ে দিতে পারেন - বাড়ির পাশের যে বাঙালি ড্রাইভারটিকে আপনি দ্বিগুণ পয়সা দিয়ে ব্যবহার করেন ও সে আপনাকে সুযোগ পেলেই কাঁচকলা দেখায় ও বিভিন্ন অজুহাতে পয়সা আদায় করে - তারাও তো আত্মহত্যাই করে চলেছে। নিজের। নিজের পরবর্তী প্রজন্মের। নিজের মাটির। অতএব এ নিয়ে মনখারাপের বিলাসিতা মানায় না। অতএব, হে বাঙালি, আপনারা বাঁচুন, ম্যাক্সিম গোর্কির মাদারের সমতুল্য সারদার থুড়ি সততার প্রতীকের ঘাসফুলগাছের ছায়ায় বাঁচুন, দাঙ্গাবাজেদের হোয়াটসয়্যাপ ফরওয়ার্ডে হিন্দু মৌলবাদী হবার বা সাধারণ মানুষের অসুবিধেকে তুড়ি মেরে ভোটবাজদের সাম্প্রদায়িক তোষনের পাঠ নিতে নিতে বাঁচুন, 'মানুষ ভুল করে বুদ্ধিজীবীদের প্ররোচনায় আমাদের উৎখাত করেছিল, আমরা তো কোনো দোষ করিনি' মার্কা সিপিয়েমিয় ভ্রান্তিতে বাঁচুন। আমার মত কাপুরুষেরা হাল ছাড়ুক, যেমন ছেড়ে চলেছে, বা চলবে।

Saturday, November 20, 2021

টুকটাক ১

আজকের ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এ রয়েছে রোমানিয়া-নিবাসী ক্যাপ্টেন ড্যান স্যান্ডু'র কথা। চল্লিশ বছর সমুদ্রযাত্রার অভিজ্ঞতার পর এবছর এপ্রিল মাসে সম্ভবতঃ তার শিডিউল্ড শেষ ভয়েজ-এ ভারত-এর কোনো এক বন্দর থেকে মালবাহী জাহাজ ভ্যান্টেজ ওয়েভ-এ বেরোনোর আগে সামান্য অসুস্থতা বোধ করেন ক্যাপ্টেন স্যান্ডু। স্ত্রীকে চিঠিতে লেখেন "চিন্তা কোরো না", লেখেন "সমস্ত কিছু ঠিক হয়ে যাবে"। 

ঠিক হয়নি। এপ্রিল মাসের 19 তারিখেই মারা যান ক্যাপ্টেন।

শেষ পর্যন্ত, অক্টোবর মাসে, যখন তেরো নাম্বার দেশ সংযুক্ত আরব আমিরশাহী, ক্যাপ্টেনকে বন্দর এ নামিয়ে রোমানিয়া-তে তার শবদেহ পাঠানোর অনুমতি দেয়, তখনো পর্যন্ত প্রায় ছমাস মৃত অবস্থায় নাবিকদের ফল-সব্জির ডিপ ফ্রিজার এ মরণোত্তর সমুদ্রযাত্রা হয়ে গেছে ক্যাপ্টেন স্যান্ডু'র। বারোটি দেশে কপালে জুটেছে প্রত্যাখ্যান।

"সভ্যতা"/"মনুষ্যত্ব" ইত্যাদি নিয়ে জনৈক মনমোহন মিত্র'র গল্প ছবিতে বলার প্রক্রিয়া যেদিন শেষ হয় সেট-এ, রায়সাহেব নাকি ডিক্লেয়ার করেছিলেন "ব্যস, আমি আমার যা বলার ছিলো বলে দিয়েছি" (আক্ষরিক সংলাপ নয়, এর কাছাকাছি)।

ক্যাপ্টেন স্যান্ডু'র কিছু বলার আছে? যেহেতু সংসার সমুদ্রে বয়সোচিত কারণে আজকের এই গল্প পড়ার পর থেকে মাঝে মাঝে ওনার সাথে একাত্মতা বোধ করার সম্ভাবনা থাকছে, কখনো দেখা হলে জিজ্ঞাসা করতে ভুলবো না। তবে তা আর সবাইকে বলবো কি করে জানি না।

Tuesday, November 9, 2021

ছেঁড়া-খোঁড়া ১

## "খাও হে চক্কত্তি"

'অগ্রদানী'র সেই ভয়াল-ভয়ংকর লাইনটা মাথায় সারাজীবন বিভিন্ন বৈচিত্র্যে বেজে এসেছে। যেমন করে 'নবীগঞ্জের দৈত্য'র দুঃখহরণ মাস্টার-এর মাথায় পড়তো অদৃশ্য হাতের গাঁট্টা আর উপদেশ, সেরকম-ই খানিকটা। কখনো নিশ্চিত আরাম ছেড়ে চরম অনিশ্চয়তার দিকে "এগোও হে"। কখনো ভেঙ্গে পড়বার পরে "তুমি তো কর্তব্যটা করেছ হে"। এরকম অনেক কিছু। 

এখন কি বাজছে? যতদূর শুনতে পাচ্ছি "এবার নীরব করে দাও হে"।

## "বাড়ি কোথায়? / আমার কোনো দ্যাশ নাই"

মৌসুমী ভৌমিক অনেকদিনের আত্মার আরাম। কিন্তু তার একটা গান, কান এড়িয়ে গেছিলো এই কিছুদিন আগে পর্যন্তও। তারপর একদিন, ইউটিউবের কানাগলি থেকে আবিষ্কৃত হল সেই গান:

"সবুজ সংকেতে
রাস্তা এপার ওপার করার সময়
পথের কোণে 
সেদিন দুটো পড়ে থাকা শব্দ পেলাম
'বাড়ি কোথায়'?
সেই থেকে আমার সঙ্গে 
ছায়ার মত ঘুরছে ফিরছে 
মাথার মধ্যে, পদ্যে গদ্যে
গানের ছন্দে, হাওয়ার গন্ধে
'বাড়ি কোথায়'?"

সেই থেকে উত্তর খোঁজা চলছে। আংটি চাটুজ্জ্যের ভাই কখনো ফিরতে চাইলে ফিরবে কোথায়, এক্কেবারে শেষ বারের মতো হারিয়ে যাবার আগে? 
ঋত্বিক নিশ্চই জানতেন শুধু কাঁটাতার পেরোনো মানুষই 'দ্যাশ' খোঁজে না। 

## "সে ডাকে আমারে, বিনা সে সখারে, রহিতে মন নারে"

ঔদাসীন্য, নাস্তিকতার ধাপ পেরিয়ে অজ্ঞেয়বাদ এর দরজায় কড়া নাড়া, যা ধীরে ধীরে অদ্বৈতবাদ ছুঁতে আনাড়ি চেষ্টা করছে, তা কি নিতান্তই মানসিক অক্ষমতার একটা ম্যানিফেস্টেশন? 

উত্তরে বার্গম্যান এর সেভেন্থ সিল এ যুদ্ধফেরত নাইট ম্যাক্স ভন সিডো ও তার পার্শ্বচর গুন্নার জর্নস্ট্যান্ড এর মধ্যের কথাবার্তার ফ্রেমটা পড়ে থাকে শুধু।

Friday, January 8, 2021

চল্লিশ পেরোলেই!

চল্লিশ পেরোলো? কিছুটা নিজের জন্য বাঁচা শুরু করেছেন তো?
গ্রীক পুরাণের য়্যাটলাস এর মত পৃথিবীর বোঝা আপনার ঘাড়ে নেই
এমনকি আপনার কর্মস্থল-ও দিব্যি চলতে পারে আপনাকে ছেড়ে দু একটা ঝাঁকুনি দিয়ে
বাজারে যে লোকটার থেকে সবজি নেন
তার দিকে দাম বেশি নেবার সন্দেহের দৃষ্টি ছাড়া অন্যভাবে তাকিয়েছেন কখনো?
দু একটা সুখ দুঃখের গল্প করে আর দরাদরি না করে ফেরত এসেছেন?
মাসের শেষে ময়লা ফেলবার লোকের হাতে দু-দশটাকা বেশি দিয়ে দেখেছেন?
যে বৃদ্ধ প্রতিবেশী আপনাকে তার সাতপুরোনো গল্প বারবার বলে এসেছেন, প্রশ্রয় দিয়েছেন তাকে?
এই ভেবে, যে প্রত্যেকবার বলবার সময় যে খুশিটা তার মুখে ঝিলিক দিচ্ছে সেটা অমূল্য!
লোকের ভুলকে চোখে আঙুল দেখিয়ে দেওয়া বন্ধ করেছেন?
বুঝতে পেরেছেন যে ভগবান তার দুনিয়ার ভুল সাফ করবার ইজারা দিয়ে পাঠাননি আপনাকে?
বয়সে ছোটদের দরকারের থেকে একটু বেশিই উৎসাহ আর প্রশংসা গলা তুলে দিতে পারছেন?
চুল না আঁচড়ে বা একটু সাধারণ জামাকাপড়ে বাইরে যেতে লজ্জা একটু কমেছে?
যে লোক আপনাকে তাচ্ছিল্য আর সন্দেহ করে এসেছে তাকে মন থেকে বিদায় দিয়েছেন?
হাজার হোক, যে আপনার মূল্য দেয়নি, তাকে দরকারের বেশি সময় দেওয়ার দরকার বোধহয় নেই!
এই বয়সে এসে নিজের মূল্য বোধহয় আপনি জানেন।
কর্মক্ষেত্রে ইঁদুরদৌড়ে বিরক্ত না হয়ে মজা পেতে শুরু করেছেন?
এটা ভেবে, যে আপনি অন্ততঃ ইঁদুর নন!
নিজের ভালোলাগা নিয়ে থাকতে আর কথা বলতে লজ্জাটা অবশ্যই ঝেড়ে ফেলেছেন আশাকরি?

ঠিক আজকের দিনটাই আপনার শেষ দিন হতে পারে
'হতে পারে' শেষ দিনটা নিজেকে খুশি করে, নিজের মতো বাঁচছেন তো?

Saturday, October 31, 2020

সত্যজিৎ ১০০ (১)

#সত্যজিৎ_১০০ (১)

গপ্পো। ডেভিড ও. সেলজেনিক। আমেরিকান প্রডিউসার। গন উইদ দ্য উইন্ড, রেবেকা, স্পেলবাউন্ড। বদভ্যাস। ডিরেক্টরদের নোট পাঠান যখনতখন, তাদের কাজ এর দিকনির্দেশ করে। পথের পাঁচালির জাদুতে বিমোহিত হয়ে সত্যজিৎ-কে ডেকে পাঠালেন বার্গম্যান এর হাতে পুরস্কার তুলে দেবার অছিলায়, আসল উদ্দেশ্য পরিচালকের সাথে কাজ করার। ওদিকে এই বিষয়ে রায়বাবুর মানসিকতা তাঁর শুরুর জীবনে প্রভাববিস্তার করা জঁ রেনোয়ার কাছাকাছি। স্বতঃস্ফূর্ততার বিপরীতে হেঁটে, হলিউডের ছবিতে আলো-শব্দ থেকে শুরু করে পরিচালক এর দক্ষতা অব্দি একাধিকবার যাচাই করে নেবার প্রথার তীব্র বিরোধী তিনি। সেলজেনিক এর প্রস্তাব এল অচিরেই, সত্যজিৎ জানালেন তার অপছন্দ। সেলজেনিক বললেন তিনি সত্যজিৎ এর খাতিরে ভুলে যেতে চান তার অভ্যাস। সেক্ষেত্রে তিনিও রাজি, জানান সত্যজিৎ।

পুরস্কারপ্রদানের রাত্রের সন্ধ্যায় সত্যজিৎ হোটেলের ঘরে ঢুকেই দেখেন সেলজেনিকের নোট। পুরস্কার দেবার সময় ছ-সাতমিনিট কি বলতে হবে তার নির্দেশ, না বদলানোই ভালো ঠারেঠোরে এটা বুঝিয়ে দেবার সাথে।

সত্যজিৎ নিজের কথাই বললেন।

অবশ্যম্ভাবী, যুগ্ম উদ্যোগটাও অঙ্কুরে বিনষ্ট হলো।

---------------

বই: অদ্বিতীয় সত্যজিৎ
লেখক: মঞ্জিল সেন (সম্পাদনা ও টীকা: স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায়)
প্রকাশক: বুকফার্ম (ই বুক আছে, সুইফটবুকস য়্যাপে পড়েছি আমি)
খুব ভালো: বংশপরিচয় ও ছোটবেলার গল্প, সহজ গদ্য, সমস্তকিছু ছুঁয়ে যাওয়া।
আর একটু ভালো হতে পারতো: দেবতা বানাবার চেষ্টা না করা (রবীন্দ্রনাথ 'ঠাকুর' হয়ে রিডিংলিস্ট থেকে অন্তর্হিত হয়েছেন), জাম্প কাটের মত বিষয় পরিবর্তন এড়ানো।

Saturday, August 29, 2020

মারিও দি আন্দ্রেদ এর কবিতা

(সকালবেলায় প্রিয় চিত্রপরিচালক অতনু ঘোষ এর ফেসবুক দেওয়ালে মারিও দি আন্দ্রেদ নামে এক ব্রাজিলিয়ান কবি'র লেখা এই কবিতাটা দেখেছিলাম। এটা তার অক্ষম গদ্য ভাবানুবাদ)

~

বছর ঘুরতে ঘুরতে যখন হিসেব কষতে বসলাম
আর দেখলাম বেঁচে থাকার জন্য সামান্য কিছু সময়ই হাতে আছে
অন্ততঃ যে সময় পেছনে পেছনে ফেলে এসেছি তার সাথে তুলনা করলে।

নিজেকে সেই ছেলেটার মত লাগলো যে একটা চকলেটের বাক্স হাতে পেয়েছিলো
শুরুতে সে সেগুলো একটার পর একটা মুখে ভরছিলো খুশিতে
তারপর যখন তার খেয়াল গেলো শেষ হয়ে আসা বাক্সটার দিকে
তখন সে তাড়াহুড়ো ভুলে একটা একটা'র স্বাদ তারিয়ে তারিয়ে নিতে শুরু করল।

এই মুহূর্তে অনিচ্ছায় সময় দিতে হচ্ছে অগণিত মেলামেশাকে, 
যেখানে কেবল নিয়ম, পদ্ধতি, আইন-ই আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে
কোনো কিছুই বাস্তবে পাওয়া যাবে না তা জেনেও।

ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলেছি সেই মানুষগুলোর জন্য
যারা তাদের বয়সের সাথে সমানুপাতে বেড়ে ওঠে নি।

আমার সময় খুবই অল্প
তাই খুব কম সময়ে পেতে চাইছি জীবনের সারবস্তুগুলোকে
আমার বাক্সে আর সামান্য কটা চকলেট পড়ে আছে।

এইসময় সেই লোকগুলোকেই পাশে পেতে ইচ্ছা করে
যারা তাদের ভুলগুলোকে অট্টহাস্যে জোর গলায় স্বীকার করে নিতে পারে
যারা তাদের কৃতিত্বের হাওয়ায় ফুলে ফেঁপে ওঠে না
যারা তাদের প্রত্যেকটা কাজের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নেয়
অর্থাৎ যে সমস্ত লোকেরা সভ্যসমাজ এবং তার অস্তিত্ব সত্য ও সততার সাথে আজও বজায় রেখেছে।

কেবলমাত্র অত্যাবশ্যক জিনিসই জীবনকে সমৃদ্ধ করতে পারে
কাজেই আমি শুধুমাত্র তাদের সাথেই বাকি সময়টা কাটাতে চাই
যারা তাদের সুন্দর হৃদয় দিয়ে তাদের হৃদয় স্পর্শ করতে পারবে যারা অপেক্ষাকৃত কঠোর জীবনপর্বে বেড়ে উঠেছে।

হ্যাঁ, আমি খুব তাড়াহুড়োয় আছি
আমি তাড়াহুড়োয় আছি জীবনকে সেই গভীরতায় বাঁচবার জন্য যা কেবলমাত্র এই অভিজ্ঞ বয়স আমাকে দিতে পারে
আমার চকলেটের বাক্সের শেষ কয়েকটা চকলেটকে আমি হেলাফেলায় শেষ করতে চাই না।

এই শেষ চকলেটগুলোর স্বাদ হবে অবর্ণনীয়
যেগুলো শেষ করে ফেলেছি তার থেকে অনেক বেশি আকর্ষণীয়
আমি আমার শেষের সময়ে একটা পরিষ্কার বিবেকের সাথে শান্তি আর পরিতুষ্টি নিয়ে পৌঁছাতে চাই।

আমাদের দুটো জীবন
আর দ্বিতীয়টা ঠিক তখন শুরু হয় যেদিন আমরা জানতে পারি আসলে জীবন একটাই।

Friday, August 28, 2020

সব ইয়াদ রাখখা জায়গা / আমির আজিজ

(অক্ষম ভাবানুবাদ, পৃথিবীর সমস্ত ফ্যাসিস্ট শাসকদের জন্য)

~

তুমি যখন বলবে রাত, আমি লিখবো চাঁদ
তুমি কারাপ্রাচীরের মধ্যে ঠেলবে, 
আমি তার কাঁটাতারওয়ালা দেওয়ালে বিচার লিখবো
তোমার সাজানো এফ আই আর এর জবাবে, আমি গাইবো 'আমরা করবো জয়'
তুমি খুন করবে আর আমি তার প্রমাণ লিখে যাবো দেওয়ালে দেওয়ালে।

তুমি আদালতকে বন্ধু বানিয়ে হাসিঠাট্টা করবে আমাকে নিয়ে
আমরা পথে ঘাটে দেওয়ালে বিধাতার রায় লিখবো
বধিরের কানে পৌঁছে যাওয়া পর্যন্ত ইনসাফ এর আওয়াজ তুলবো।

আমাদের লেখায় সত্যের ছটা অন্ধের চোখেও আলো এনে দেবে
তোমার কালো পদ্মের জবাবে আমরা লাল গোলাপ ফোটাবো
তুমি যতই আমার জমিতে অত্যাচার এর ফসল বুনবে
আমার আকাশ আমরা বিপ্লব এর কবিতায় ভরে দেব।

সব মনে রাখবো আমরা, সমস্ত কিছু মনে রাখবো আমরা
তোমাদের লাঠির আঘাতে বা বন্দুকের নলে
আমাদের যে বন্ধুরা চিরকালের জন্য হারিয়ে গেছে
তাদের স্মৃতি আমাদের ভাঙা হৃদয় এ যত্নে রেখে দেব আমরা।

সব মনে রাখবো আমরা, সমস্ত কিছু মনে রাখবো আমরা
তোমরা যখন ছাপার কালিতে মিথ্যের ইতিহাস লিখবে
আমরা তখন আমাদের রক্তের লেখায় ভবিষ্যৎকে একদিন সত্যি শোনাবার জন্য তৈরি হব।

সব মনে রাখবো আমরা, সমস্ত কিছু মনে রাখবো আমরা।

আমাদের মোবাইল টেলিফোন ইন্টারনেট বন্ধ করে
অন্ধকার সময়ে সারা শহরকে নজরবন্দি করে
আমার ছোট্ট ঘরে মারণ হাতিয়ার নিয়ে ঢুকে আসবে যখন আমার জীবনকে শেষ করতে
আমার সন্তানকে ঘিরে মাঝরাস্তায় মারণলীলা চালিয়ে
যখন মুচকি হেসে তুমি আমায় উদ্ধার করতে হাত বাড়িয়ে দেবে
তখন সব মনে রাখবো আমরা, সমস্ত কিছু মনে রাখবো আমরা।

দিনের বেলা যখন মিষ্টি কথায় আমাদের ভোলাবে
যখন ঝুটো বাগ্মিতার জাদুতে বোঝাবে সবকিছু ঠিক চলছে
অথচ রাতের অন্ধকারে প্রতিবাদীর গায়ে তুলবে লাঠি
আমার ওপর গুলি চালিয়ে আমাকেই বানাবে সন্ত্রাসবাদী
তখন সব মনে রাখবো আমরা, সমস্ত কিছু মনে রাখবো আমরা।

আমার অস্থিমজ্জায় লিখে রাখবো আমি এই হানাদারির কাহিনী
যখন তুমি আমার পরিচয় এর নথি চাইবে
আমি আমার অস্তিত্বর প্রমাণ অবশ্যই রেখে যাব
এই যুদ্ধ চলবে আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত্য
সমস্ত কিছু মনে রাখবো আমরা।

একথাও মনে রাখা হবে কেমনভাবে তুমি ভাঙতে চেয়েছিলে আমার প্রাণাধিক প্রিয় দেশ
আমাদের দেশকে জুড়ে রাখবার লড়াই মনে রাখবো আমরা
যখনই কাপুরুষতার প্রসঙ্গ উঠবে ভবিষ্যতে, তোমাদের উদাহরণ মনে রাখবো আমরা।

আর যখনই কথা উঠবে জীবনের
আমাদের নাম উচ্চারিত হবে চিরদিন
যাদের মজবুত মনকে বিভেদের হাতুড়ি দিয়েও ভাঙা যায় নি
যাদের বিবেককে তোমাদের মতো পয়সা দিয়েও কেনা যায় নি।

কিছু লোক যারা ঝড়ের মুখেও মাথা নোয়ায় নি
কিছু লোক যারা মারা যাওয়া পর্যন্ত জীবন্মৃতের পর্যায়ে গণ্য হয়নি।

তোমার চোখ হয়তো পলক ফেলতে ভুলতে পারে
পৃথিবীও হঠাৎ আহ্নিকগতি ভুলে দাঁড়িয়ে পড়তে পারে তার অক্ষে
কিন্তু আমাদের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেবার এই প্রচেষ্টা
আমাদের প্রতিবাদী কন্ঠস্বর-কে দাবিয়ে রাখবার এই ষড়যন্ত্র
সমস্ত কিছু মনে রাখবো আমরা।

তুমি যখন বলবে রাত, আমি লিখবো চাঁদ
তুমি কারাপ্রাচীরের মধ্যে ঠেলবে, আমি তার কাঁটাতারওয়ালা দেওয়ালে বিচার লিখবো
তোমার সাজানো এফ আই আর এর জবাবে, আমি গাইবো 'আমরা করবো জয়'
তুমি খুন করবে আর আমি তার প্রমাণ লিখে যাবো দেওয়ালে দেওয়ালে।

তোমার আঘাতে মৃত্যুর পর আমার আত্মা লিখবে
তোমার হননের সমস্ত প্রমাণ লিখবে
তুমি আদালতকে বন্ধু বানিয়ে হাসিঠাট্টা করবে আমাকে নিয়ে
আমরা পথে ঘাটে দেওয়ালে বিধাতার রায় লিখবো
বধিরের কানে পৌঁছে যাওয়া পর্যন্ত ইনসাফ এর আওয়াজ তুলবো।

তোমার কালো পদ্মের জবাবে আমরা লাল গোলাপ ফোটাবো
তুমি যতই আমার জমিতে অত্যাচার এর গদ্য লিখবে
আমরা আকাশ বিপলব এর কবিতায় ভরে দেব
আমাদের লেখায় সত্যের ছটা অন্ধের চোখেও আলো এনে দেবে।

যাতে তোমাদের নামে ঘৃণার নামকরণ হয় ভবিষ্যতে
যাতে তোমাদের নামে কালো কালিতে লেখা হয় ইতিহাস
তোমাদের নাম, তোমাদের কীর্তি, কিছুই ভোলা হবে না
সমস্ত কিছু মনে রাখা হবে।

😶

Tuesday, May 19, 2020

ভবেশবাবুর ভুল

করোনা-সন্ত্রস্ত পশ্চিমবঙ্গের একটি প্ৰ(!)খ্যাত বেসরকারি হসপিটাল। করোনা আবহে এবং সম্ভবতঃ স্টাফবিহীনতায় এন 95 মাস্ক এর থেকেও বেশি স্ক্রিনিং এর পর রোগীকে ভেতরে যেতে দেওয়া হচ্ছে। প্রথমে ভিডিও কল-এ রোগীর আত্মীয়কে সহস্রাধিক প্রশ্ন করা হচ্ছে, লজিক্যাল রিজনিং থেকে জেনারেল য়্যাওয়ারনেস প্রায় সবকিছুই থাকছে সেই বিচিত্র প্রশ্নবিচিত্রায়। দশজনের দুজন রোগী এই প্রশ্নের ধাক্কায় বিদায় নিচ্ছেন। ও, তারও আগে, এই ভিডিও কল এর লাইন এ দাঁড়িয়ে  ওপারে কাউকে না পেয়ে বিদায় নিচ্ছেন প্রায় মরে যাওয়া, হাত পা ভাঙ্গায় আর্তনাদ-রত রোগীরা, সেটিও দশটির মধ্যে দুটি। ভিডিও কলের পর রোগী খোলা আকাশের নিচে স্ট্রেচার বা হুইল চেয়ার এ বসে অপেক্ষা করছেন ভেতরের অথবা পরপারের ডাক আসার, এই শবরীর প্রতীক্ষায় বিদায় নিচ্ছেন আরো দুজন।বাকি চারজনকে খপ করে ধরে ঝপ করে ভেতরে ঢুকিয়ে নেওয়া হচ্ছে এবং তাতে কোনো বাড়ির লোককে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। এরপর শুরু হচ্ছে বাড়ির লোকের অন্তহীন প্রতীক্ষা, যার সময় গড়ে তিন থেকে পাঁচ ঘণ্টা। প্রায় জনা পঞ্চাশেক বাড়ির লোকের জন্য খোলা আকাশের নিচে চারটি চেয়ার ছেলেবেলার মিউজিক্যাল চেয়ার এর রোমাঞ্চ ফিরিয়ে দিচ্ছে। এই প্রতীক্ষার অবসানে, ভেতরে একজন আত্মীয়কে ডেকে নেবার পর কোয়ার্টার বা হাফ-মৃতদের হস্তান্তর করে পরের দিন ওপিডি দেখাবার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এর মাঝে রোগীকে ভর্তি করা হবে ধরে নিয়ে সাতদিনের ওষুধ কিনে জমা দিতে হচ্ছে, এবং তারপর রোগীকে ছেড়ে দিয়ে সেই ওষুধ কালগর্ভে বিলীন হতে দেখা যাচ্ছে, কিন্তু সে সব 'সামান্য ঘটনা' থাক বরং।

এই রণক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে, থুড়ি, হুইলচেয়ার এ বসে, রনেন মন্ডল ও ভবেশ মাঝি, দুজনেই পূর্ববর্ণিত দুটি রাউন্ড (ভিডিও কল এবং পার্সোনাল ইন্টারভিউ) ক্লিয়ার করেছেন বলে অসুস্থতার মধ্যেও সামান্য খুশি নিয়ে বসে ছিলেন ঘন্টা দুয়েক। এর মাঝেই উশখুশ শুরু করেন দুজনেই এবং দু ঘন্টা পেরনোর পর মৃদু বাপ-বাপান্তও। এরপর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসেন এক দেব-দূতিকা য়্যাটেন্ডেন্ট, থার্মাল স্ক্যানার এর গয়না ধরে।

"রনেন মন্ডল কে?" জিজ্ঞাসা তাঁর।

অরিজিনাল রনেন মন্ডল গত দুঘন্টা ধরে প্রচুর উষ্মা জানিয়ে বউ এর হাতে দুটি বিস্কুট ও একঢোক জল খেয়ে হুইলচেয়ার এ ঝিমোচ্ছিলেন, এই ডাক শুনতে পাননি।

ভবেশ বাবু ড্রেনের পাশে জঙ্গলের ধারে বসবার জন্যেই বোধহয় মশা তাড়াতে তাড়াতে বেশ সজাগ ছিলেন। এই সুযোগে তিনি দিলেন হাত তুলে, যেমতি হস্ত উত্থান করে নার্সারি বালকে, দিদিমনির রোলকলে।

য়্যাটেন্ডেন্ট সেই দেখে খাতা নিয়ে এলেন ভবেশ বাবুর কাছে। জিজ্ঞাসা করলেন, "আপনিই রনেন মন্ডল, আপনারই ডায়ালিসিস তো?"

ভবেশবাবু থমকে গেলেন। এদিকে রনেন বাবুর স্ত্রী, যিনি ষাটোর্ধ্ব এবং গত দুঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তিনি এই ঘটনাপ্রবাহের আশেপাশে এসে পড়েন। তিনি 'ডায়ালিসিস' শব্দবন্ধ শুনেই আরো সজাগ হয়ে বলেন "আমার পেশেন্ট এরও ডায়ালিসিস ছিল যে? অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে আমরা!"

য়্যাটেন্ডেন্ট জিজ্ঞাসা করেন "কি নাম আপনার পেশেন্ট এর"?

রনেন বাবুর স্ত্রী নাম বলতেই য়্যাটেন্ডেন্ট ঘুরে তাকান ভবেশ মাঝির দিকে, "ও দাদু, তুমি রনেন মন্ডল বললে যে?"

ভবেশ বাবু আত্মসমর্পণ করলেন, "তোমরা তো এই বাইরে বসিয়ে রেখেছো মা, বুকের ব্যাথায় আর মশার কামড়ে নাম ভুলে গেলে কি করি বলো?"

য়্যাটেন্ডেন্ট রেগে উঠতে উঠতেও ফিক করে হেসে রওয়ানা দেয় রনেন মন্ডল এর হুইলচেয়ার ঠেলতে ঠেলতে। "কি যে করেন না দাদু"।

Saturday, March 28, 2020

আই লীগ,মোহনবাগান, অথবা সুখ অসুখের দোটানা

(লেখাটা ওয়েবম্যাগ চার নম্বর প্ল্যাটফর্মে প্রকাশ হয়েছে। নামকরণ করেছেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য। আনএডিটেড ভার্সন ও লিঙ্ক রইল)

'ক্লাবটা বেচে দিলো'? আমার মত শখের ফেসবুক মোহনবাগানি নয়, যারা খেলাটা মাঠে গিয়ে দেখেন, হাসেন, কাঁদেন, গালাগালি দেন, মাথায় তুলে নাচেন, ঝগড়া করেন, সেই খাঁটি লোকগুলোকে থম মেরে যেতে দেখেছিলাম এটিকের সাথে সংযুক্তিকরণ এর খবরটা আসার পরে। আমি নিশ্চিত, যে সমস্ত ইস্টবেঙ্গল সমর্থক এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রায় একশোবছর ধরে বংশানুক্রমে উপভোগ করছেন , যাবতীয় কটূক্তি সত্ত্বেও খানিকটা বিরক্তিমিশ্রিত অসহায়তা তারাও অনুভব করেছেন। কলকাতা লীগ, ডুরান্ড বা বাংলাদেশ সফর এর ব্যর্থতার পর এই খবর কফিনে শেষ পেরেক ঠোকার শব্দের মতই শুনিয়েছিল ক্লাবপাগল মানুষগুলোকে। হবে নাই বা কেনো? মরসুমের শুরুতে স্পন্সর এর অনিশ্চয়তা, বিদেশি কোচ যিনি ময়দানি ভাষায় যোগ রাখতে পারেন না সমর্থকদের সাথে, অন্যতম ভরসা চামরোর ব্যর্থতা, এসবও তো দেখতে হয়েছে ওনাদের।

আইলিগ এর শুরুতেই হোঁচট, যার মধ্যে চার্চিল এর বিরুদ্ধে চারগোল হজম, শৌখিন বাবু সমর্থকরা তো হিসেবের খাতা থেকে ক্লাবটাকেই প্রায় বাদ দিয়ে ফেলেছিলেন। এরপরের ইতিহাসটা কিন্তু দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তন এর। জানুয়ারির মাঝামাঝি সুখের দিন এর সমর্থকরাও নড়ে বসতে বাধ্য হলো চিরশত্রু-বিজয়ের পর। ব্যক্তিগতভাবে মনে করতে পারি, মোহনবাগান কোনো একটা ম্যাচে নিজেদের মধ্যে টানা একুশটা মাঠজোড়া নয়নাভিরাম পাস খেলে উপরে উঠে আসার ভিডিও দেখে ছিটকে গিয়ে কলকাতা টিভিতে খেলা দেখতে শুরু করি আমি।

তারপর এলো ১০ই মার্চ। চেন্নাই সিটি ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধে অল্পের জন্য ফসকে যাবার পর, বর্তমান সময়ের নেমেসিস আইজল এফ সি সংহার মরশুম জোড়া বিশ্বস্ত বাবা দিওয়ারার গোলে, পঞ্চমবার জাতীয় লীগ বা আই লীগ জয় চার ম্যাচ ও প্রায় একমাস হাতে থাকতে। সেই আইজল, যাদের হাতে শেষ মুহূর্তে শেষ হয়েছিল ২০১৬-১৭'র চ্যাম্পিয়নশিপ এর দৌড়। স্প্যানিশ কোচ কিবু ভিকুনার অভিভাবকত্বে, গোলমেশিন বাবা দিওয়ারার দাপটে, হৃৎপিন্ড ফ্রান গঞ্জালেজ, মস্তিষ্ক জোসেবা বেইতিয়া, শিরদাঁড়া মোরান্তের নেতৃত্বে নাওরেম, শেখ সাহিল, শুভ ঘোষরা গরুর গাড়ির মেজাজে শুরু হওয়া মরসুমকে বোয়িং এর স্বাচ্ছন্দ্যে শেষ করল আর ছুঁয়ে ফেললো ডেম্পোর রেকর্ড আর আধুনিক ভারতীয় ক্লাবফুটবলের প্রবাদপ্রতিম কোলাসোকে।

খুশি? সবাই। শেষ ২০১৪-১৫ জয়ের দ্রোনাচার্য সঞ্জয় সেন খুশি। তবে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন কোনো বাঙালি কোচ মরসুমের শুরুর এতবড় ব্যর্থতা পেরিয়েও ক্লাবকর্তাদের আনুকূল্য পেতেন কিনা। সাথে মনে করিয়ে দিয়েছেন একের পর এক ক্লাব বন্ধ হয়ে যাওয়া ভারতীয় ফুটবল এর বর্তমান আই লীগ সে সময়ের ১৪ দলের আইলীগের থেকে একটু হলেও আলাদা। পোড় খাওয়া ময়দানি সুভাষ ভৌমিক অবশ্য এ ব্যাপারে দ্বিমত। তারমতে ভারতীয় ফুটবল এ মুহূর্তে আরো কঠিন কারণ আগে কেবলমাত্র গোয়া আর মুম্বাই ঘরানার মোকাবিলা করতে হত, সেখানে এখন দেশের প্রত্যেক কোণা থেকে ক্লাব, যাদের ধরণ-ধারণ ও মাঠের চরিত্র আলাদা। সুভাষ আরো উচ্ছ্বসিত কারণ তার মতে মূর্খরা বুঝেছে ফুটবলটা এখনো কলকাতার। টিপ্পনি কেটেছেন কালো কাপড় ঝুলিয়ে অনুশীলন করতে হয়নি কিবু ভিকুনাকে এই সাফল্যের জন্য। সেই কিবু, যিনি বলেছেন তিনি রাত জাগলে ফুটবলাররা আনন্দ করতে পারবে, তাই মরশুম শেষ হবার আগে কোচের ছুটি নেই। আইজল ম্যাচ এর খেলায় খুশি ছিলেন না স্প্যানিশ টেকনিক ও সৌন্দর্যঘরানার কিবু, জানিয়েছেন গোল পাওয়ার চাপে খেলা ভালো হয়নি, তাই ডার্বিতে নজর রাখতে চান। কর্তারা খুশি। ক্লাববিক্রির অপবাদ (?) শুনতে হয়েছে। স্প্যানিশ বাস ড্রাইভার এনেছেন বলে কটূক্তি শুনতে হয়েছে। কল্যানী স্টেডিয়ামকে হোমগ্রাউন্ড বেছে নেওয়ার ঝুঁকি নিতে হয়েছে, যদিও সে জায়গা দিনের শেষে আবেগে দলকে সবম্যাচে মনস্তাত্বিক লিড দিয়েছে।

কিন্তু সত্যিই কি সব এতটাই সুখের? জয়ের প্রাবল্যে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসা (এই লেখার সময় পর্যন্ত) চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীকেও যখন বামন লাগছে, তখন অপ্রিয় দু-একটা কথা বলা কি দরকার? এই যেমন, ভারতীয় ফুটবল লীগ জিতে স্প্যানিশ পতাকা মোড়া সেলিব্রেশন-এ কেন ধীরে ধীরে বাংলার মাঠ থেকে সাফল্যের আলো সত্ত্বেও অন্ধকারে হারিয়ে গেলেন বাংলার কোচ ও হাতে গোনা কয়েকজন বাদে বাংলার ফুটবলার-রা? অথবা, সামনের মরশুমে কি হবে 'আমাদের' মোহনবাগানের 'কর্পোরেট' এটিকের হাতে পড়ে? কর্তারা যতই বলুন পরিকল্পনা আছে, সামনে স্পষ্ট কিছু আলোর রেখা নেই। তবে সুখের দিনে থাক না সেসব কূটকচালি।

https://4numberplatform.com/?p=17809

Saturday, December 7, 2019

বাজে গল্প ৪

অমিত্রসূদন বাবু বেডে শুয়েই হাঁসফাঁস করছিলেন। ডাক্তার অম্বুজাক্ষ তলাপাত্রের দুপুরের রাউন্ডের অপেক্ষাতে উৎসুক। ডাক্তারবাবু বেডের পাশে এসে দাঁড়াতেই জিজ্ঞাসা করলেন সেই প্রশ্নটা যেটা ভদ্রতা ও ভয় এর বশে করে উঠতে করতে পারেননি ভর্তি হওয়ার দিন থেকে। ডাক্তারবাবু বড়জোর একমিনিট সময় খরচ করেন রোগীপিছু রাউন্ডের সময়, বড় কোন সমস্যা না থাকলে, তাই ভনিতা কম রাখাই ভালো।

"কত সময় আছে আমার হাতে আর ডাক্তার তলাপাত্র"?

অম্বুজবাবু সকালের রিপোর্টের ওপর গম্ভীর মুখে দ্রুত চোখ বোলালেন, হেড নার্স মনসালতা মাইতিকে ডেকে খুব মৃদু স্বরে কিছু একটা দু-এক-কথা'র উপদেশ দিলেন।

"বললেন না যে ডাক্তারবাবু?" অমিত্র অস্থির।

দুপাশে অল্প একটু ঘাড় নেড়ে অম্বুজ বললেন "দশ"!

অমিত্র বিহ্বল হয়ে পড়লেন। "'দশ'??!! ছেলেকে নিউ জার্সি থেকে ডেকে পাঠাই তাহলে ডাক্তারবাবু?? ফিরিঙ্গি বে করেছে বলে মুখ দেখব না বলেছিলাম!" 

তারপরে বাস্তববুদ্ধি ফিরলে নিজেকে একটু সামলে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, "ইয়ে, 'দশ' কি ডাক্তারবাবু? মাস? বছর তো নিশ্চই নয়? গড়পারের বাড়িটা বেচে দেব ভাবছিলাম, দাম পাচ্ছিলাম না, ভাবলাম বছর খানেক ধরে রাখি, অদ্দিন বোধহয়?? য়্যা??"

ডাক্তারের কালো হয়ে আসা মুখের দিকে তাকিয়ে আবার ভেবলে গেলেন অমিত্রসূদন। "তাহলে কি 'দিন' ডাক্তারবাবু? গিন্নি আজ মেয়ের বাড়ি গেছে মেয়ের ননদের আইবুড়ো ভাত-এ, বলে গেছে একটা দিন যেন না জ্বালিয়ে যেন ওর হাড়ে বাতাস লাগাই! একটা ফোন করি গিন্নিকে?"

কেবিনজোড়া নৈঃশব্দ্য। এবার নিয়তির হাতছানি ধরতে পারছেন অমিত্র। ফ্যাসফেসে গলায় শুধু জিজ্ঞাসা করতে পারলেন, "তবে কি ঘন্টা? য়্যা? ও মনসাদিদি, আজ রাতে আর ওই জ্যালজেলে স্যুপ নয়, একটু পেঁয়াজ রসুন দে' মাংস খাওয়াতে পারো? ও ডাক্তার? 'ঘন্টা'? বললে না যে?"

ঘরে ঢোকার মিনিটখানেকের মধ্যে গম্ভীর মুখে বেরিয়ে যেতে যেতে অম্বুজ বললেন "নয়"!

Wednesday, November 27, 2019

স্মৃতি

"কাকিমা, একটু চিনি দেবে? পরীক্ষার পড়া করতে রাত জাগার ব্যাপার আছে আমাদের তিনজনের, এদিকে এই রাত এগারোটায় দেখছি চা কফি করবার চিনিই নেই" ছায়াকাকিমা দরজা খুলতেই সোহম জিজ্ঞাসা করল।

সোহমরা তিনবন্ধু সস্তায় ভাড়ায় পেয়ে গেছিল কেষ্টপুর এর এই চারতলার ফ্ল্যাটটা মাসদুয়েক আগে। উল্টোদিকে শুধু ষাটোর্ধ্ব ছায়াদেবী, আর তার ক্যানসার আক্রান্ত স্বামী মনমোহন। সোহমরা তিনজনেই মফস্বল থেকে এসেছিল বলেই বোধহয়, মায়ের থেকেও বেশি বয়সী ছায়াকে দুম করে 'ছায়াকাকিমা' বানিয়ে ফেলতে সময় লাগেনি। ছায়াও ছেলের বয়সী এই তিনজনকে সামনে পেয়ে ভরসা পেয়েছিলেন, বাড়িতে অসুস্থ লোক, রাতবিরেতে যদি কখনো বিপদে পড়তে হয়। এদের মধ্যে সোহম সবথেকে মিশুকে বলেই, মনে হয় ওর সাথে যত গল্প ছায়ার, সোহমও বৃদ্ধাকে দেখে একটা মায়ায় পড়েছে, ওর গ্রামের বাড়িতে থাকা বুড়ি জ্যেঠিমাকে মনে পড়ে যায় ওনাকে দেখে। সোহম কোনদিনও বাড়িতে ঢোকেনি, কিন্তু যখনই দরজার বাইরে বা বাজারে দোকানে দেখা হয়েছে অন্ততঃ পাঁচ দশ মিনিট গল্প করেই ছেড়েছেন ছায়া। তবে ওঁর বাড়িতে বেল বাজানো এই প্রথম।

ঘরের ভেতরে খুব আবছা আলো। সোহম এর খারাপ লাগলো এটা ভেবে, ছায়াকাকিমা হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। যদিও ভদ্রমহিলা বলেছিলেন উনি রাত বারোটার আগে ঘুমোন না। মনমোহনকে দিনের শেষ ওষুধ রাত বারোটায় খাইয়ে তবে ওর ছুটি।

ছায়া ভেতর থেকেই সোহমকে বললেন, "আয়, তুই ভেতরে এসে বোস, আমি দিচ্ছি"।

সোহম ভেতরে ঢুকে এলো। ঘরে একটা ফ্যাকাশে হলুদ আলো। ছায়াকাকিমার মুখ অব্দি দেখা যাচ্ছে না এমন সে আলোর জোর। আরেকটা অদ্ভুত ব্যাপার, মেঝে জুড়ে ছড়ানো রয়েছে অনেক রকম জিনিসপত্র, এমনকি একটা ক্রিকেট ব্যাটও দেখলো সোহম।

"ঘর গোছাচ্ছিলে কাকিমা?"

ছায়া রান্নাঘরের দিকে যেতে গিয়ে আটকে গেলেন। একটু হেসে বললেন "না রে বাবা, ও আমার পাগলামি বলতে পারিস"।

"কিসের পাগলামি? বলো না!"

"তোর কাকু যবে থেকে এই মারণ রোগে ভুগছে তবে থেকে আমার খুব ভয় লাগতো জানিস?" ছায়া বললেন। "সর্বক্ষণ মনে হতো যেদিন ও ছেড়ে চলে যাবে সেদিন আমি কি করব? তিনকুলে তো কেউ নেই আমাদের"।

সোহম সেটা আগেই দেখেছে। এই দুমাসে কাউকে ওদের ঘরে আসতে দেখেনি। মনমোহন দরজা খুলে রেখে মাঝে মাঝে বাইরের ঘরের চেয়ারে এসে বসতেন, তাও বোধহয় গত দু সপ্তাহে সেটাও দেখা যায়নি একবারের জন্যেও।

ছায়া বলে চললেন। "তাই যে কাছের মানুষগুলো আগেই আমায় ছেড়ে চলে গেছে, তাদের স্মৃতিজড়ানো এক একটা জিনিস এই চোখের সামনে ফেলে রাখতে লাগলাম। যাতে করে এই চলে যাওয়াটা মানিয়ে নিতে পারি সময় হলে পরে"।

সোহম এর মন খারাপ হয়ে গেলো। সন্ধ্যে থেকে পড়ে পড়ে এমনিতেই মাথা ধরে গেছিলো, তাই বুড়িকে একটু কথা বলে সঙ্গ দিতে ইচ্ছে গেলো।

"ওইটা কি পড়ে আছে? চাইনিজ চেকার?"

ছায়া ফিক করে হেসে বললেন, "হ্যাঁ রে। আমার বাবা ছোটবেলায় খেলনা কিনে দেবার ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। এইটা লুকিয়ে কিনে দিয়েছিল মা। লুকিয়ে চিলেকোঠার ট্রাংক এ ভরে রাখতাম। বিয়ের পরের দিন যখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছি, বাবা এইটা হাতে তুলে দিলো। বলল, মা, বাড়ির প্রাণটা তো নিয়েই যাচ্ছিস, আমার অপরাধবোধটাও নিয়ে যা।" একটু চুপ থেকে ছায়া বললেন, "জানিস? বাবা কোনদিন এত লম্বা কথা বলেননি আমার বা ভাইয়ের সাথে। খুব কড়া শাসন এ থাকতাম আমরা। এই কথার পরে আমার তো দু চোখ ভরা বন্যার জল"।

"তোমার ভাই আছে? এখন কোথায় থাকেন?" সোহম জিজ্ঞাসা করল।

ছায়া কিছুক্ষণ চুপ। তারপরে বললেন "বাবা চলে গেলো বিরানব্বই সালে, মা তার একমাসের মধ্যে ঠুনকো জ্বর এ, বাবলু তো বিয়ে টিয়ে করেনি, জন্ম বাউন্ডুলে, ধর্মতলার কোনো একটা ট্রাভেলস কোম্পানিতে লোকজনদের গ্রূপের সাথে ট্যুর অপারেটর হিসেবে যেতো এদিক ওদিক। মাঝে মাঝে আবার একা একাই বেরিয়ে পড়তো। হাতে কেবল ওই কালো ক্যাম্বিসের ব্যাগটা, ওই যেটা সোফার সামনে পড়ে আছে দেখ। দুহাজার তেরোতে হঠাৎ একদিন এসে বলল, 'দিদি, কেদারনাথ চললাম, একাই, এই ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়েছিলাম বাড়ি থেকে, তারপর মনে হলো হিমালয় এর কোলে স্বয়ং মহাদেব এর বাড়ি যাবো, ব্যাগ কিসের? এটা রাখ তোর কাছে, ফিরে এসে নেবো'খন'!"

ছায়া বলে চললেন, "সে ফেরা আর হলো না জানিস? মেঘ ভেঙে না কিভাবে যেনো বৃষ্টি নামলো কেদারনাথ এ, অনেক লোক তলিয়ে গেলো, ভাই আর ফিরলো না। তোর কাকু ওই খারাপ শরীর নিয়ে অনেকবার এ অফিস ও অফিস করেছেন খোঁজ মিলবার আশায়। জামাইবাবু খুব ভালোবাসতো তার উড়নচন্ডী সংসার না করা শালাকে। কিন্তু বাবলু আর ফিরলো না।"

সোহম এর মন আরো খারাপ হয়ে গেলো। কিন্তু ছেড়ে উঠে আসতেও মন দিলো না। নিতান্তই কথা চালিয়ে যেতে জিজ্ঞাসা করলো "আর ওই ব্যাট?"

"ও তো টুবলুর। টুবলু নিচের ফ্ল্যাটে এসেছিল বছর দুয়েক আগে। বছর আটেক বয়স। সারাক্ষণ দেখা হলেই বকবক বকবক। এই ব্যাটটা আমি কিনে দিয়েছিলাম। যদিও ওর সব খেলা ওর বা আমাদের ঘরের মধ্যেই। নীচে যেতে চাইত না খুব একটা। ওর মা'ই জোর করে পাঠাতো যাতে সবার সাথে মিশতে পারে। এইভাবেই এক বিকেলে নীচে খেলতে গিয়ে ফিরলো না ছেলেটা, বল কুড়োতে গিয়ে সোজা গাড়ির তলায়"। শিউরে উঠলেন ছায়া। "ওর বাবা-মা আর থাকেনি এই বাড়িতে, এখনো তালাই লাগানো আছে দেখবি"।

আর বসতে ইচ্ছে গেল না সোহম এর। মনটা ভারী হয়ে গেছে। কাল পরীক্ষা। বললো, "আছছা কাকিমা, পরে আসবো, রাত অনেক হলো, চিনিটা দাও"।

ছায়া দাঁড়িয়েই রইলেন। ঘরের ভেতর থেকে একটু একটু অস্পষ্ট কথাবার্তার শব্দ ভেসে আসছিল অনেকক্ষন। সোহম ভাবছিলো মনমোহন কাউকে ফোন করছেন হয়ত। সেই আওয়াজ আরেকটু যেনো বাড়লো। দুটো গলা? কেউ এসেছে নাকি, যাক গে, ওর কি, সোহম ভাবলো।

ছায়া হাতের আঙ্গুল তুলে ঘরের মেঝেয় পড়ে থাকা একটা চৌকো চ্যাপ্টা জিনিসের দিকে দেখিয়ে সোহমকে জিজ্ঞাসা করলেন, "আর ঐটা কি বল তো?"

সোহমের আর এই খেলাটা ভালো লাগছিলো না। কিছু না বলে সোজা পড়ে থাকা জিনিসটা হাতে তুলে নিলো। দেখলো ওটা মনমোহন আর ছায়ার একটা পুরোনো ছবি, সম্ভবতঃ বিয়ের পরের, ফ্রেম করে রাখা আছে। জিজ্ঞাসু চোখে ছায়ার দিকে তাকাল সোহম, ছায়ার মুখের কাছটা বড্ড অন্ধকার।

ছায়ার গলার স্বর যেন অনেক দূর থেকে ভেসে এলো, "যতই ভেবেছিলাম এই সব করে চলে যাওয়াটা মানিয়ে নেব, পারলাম না রে, তোর কাকু আজ দুপুরে চিরদিনের জন্য চলে গেলেন, চোখে পুরো অন্ধকার নেমে এলো, ঘুমের বড়িগুলো সব একসাথে মুখে পুরে দিলাম, যখন ঘুম ভাঙলো, দেখলাম বাবলু শিয়র এ এসে বসে আছে, তোর কাকুর সাথে জমিয়ে গল্প করছে, এবারে সবাই একসাথে বেরিয়ে যাবো ভাবছি, যদিও তাড়া নেই কারোর, কারণ কোথায় যাবো তো জানা নেই, এমন সময় তুই বেল বাজালি"।

সোহম এর পা আর গলা যেন কেউ বেঁধে রেখেছে, তবুও সর্বশক্তি দিয়ে পেছনে হেঁটে দরজার বাইরে যাবার চেষ্টা করল, অন্ধকারটা যেন আরো বেড়েছে ঘরের মধ্যে, শুধু ছায়াকাকিমার শরীরের আশেপাশে আলোর ছিটে।

বেরিয়ে যেতে যেতে ছায়াকাকিমার গলা শুনলো শেষবারের মতো, অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার আগে, "চিনিটা তো নিয়ে যা বাবা, রান্নাঘরেই পেয়ে যাবি, সামনেই, এত রাত্রে আর ......"!