লিজো জোস পেলিসেরি। ভারতের হাতে গোনা চূড়ান্ত প্রতিভাবান নিউ এজ পরিচালকের একজন। "ই মা ইউ" নামের একটা মাল্যালম ছবির মাধ্যমে তার কাজের সাথে আমার প্রথম পরিচয়। চৈতন্য তামানে বা আচল মিশরা'র মতই হতবাক করে দেওয়া ছিলো সেই প্রথম দর্শন।
মামুটি। যখন ইন্টারনেট ছিলো সর্বাধিক বাহান্ন কেবিপিএস-এর, আঞ্চলিক সিনেমার সাবটাইটেল দুরদর্শন-এর রোব্বার দুপুরের ছবি ছাড়া পাওয়া ছিলো দুর্লভ, সেই সময়ে অগুনতি হিন্দি ছবি দেখা ছাড়াও কেবল টিভিতে আরেকটা নেশা পেয়ে বসেছিলো আমাকে। এশিয়ানেট টিভি। মাল্যালম সিনেমা। মামুটি আর মোহনলাল। ভাষার দুরলঙ্ঘ দূরত্ব সত্ত্বেও। আজ এই সত্তরোর্ধ বয়সেও দুজনেই নিজেকে ভাঙছেন, গড়ছেন। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই ভারতবর্ষের সর্বকালের সেরা দশ নায়ক অভিনেতা'র দুজন একই রাজ্যের বাসিন্দা।
নানপাকাল নেরাথু মায়াককম। নেটফ্লিক্স এ আছে। লিজো আর মামুক্কা'র যুগলবন্দী। অবশ্য থেনি ঈশ্বর এর ক্যামেরা আর সম্পূর্ণ সাউন্ড ডিজাইনিং টিমকে একটুকুও কম প্রাধান্য দেওয়া যাবে না। সে অর্থে কোনো কলাকুশলীকেই নয় অবশ্য। নামের আক্ষরিক অর্থ "দুপুরের একটি ঘুম", লিজো ইংরেজি সাবটাইটেল এ নাম রেখেছেন "লাইক য়্যান আফটারনুন ড্রিম"।
জেমস। মাল্যালি। রুক্ষ। ভগবৎ প্রসঙ্গে উদাসীন। পরিবারকে ভালোবাসে। তামিল খাবারদাবার বা লোকজন বিশেষ পছন্দ করে না। স্ত্রী আর বছর বারোর ছেলে। সম্ভবতঃ একটি ধর্মীয় নাটক-গানের দল নিয়ে তামিলনাড়ুর একটি চার্চে যায় নিজেদের গ্রাম থেকে, নিজেদের জন্য একটি বাস ভাড়া করে। জেমস'ই দলের ম্যানেজার বিশেষ। দলের সবাই ফেলে এসেছে কেরালায় নিজেদের দৈনন্দিন কাজকর্ম বা ব্যবসা, সবার মধ্যে ফেরবার তাড়া।
সুন্দরম। তামিলনাড়ুর এক ছোট গ্রামের বাসিন্দা। বাড়িতে স্ত্রী, মেয়ে - সম্ভবতঃ ওই বছর বারোর, অন্ধ মা, বাবা, ভাই। সামান্য চাষবাস আর গরুর দুধ বিক্রি। বছর দুয়েক আগে ক্ষেতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। থানা, পুলিশ। খোঁজ পাওয়া যায় নি আর।
জেমসের দল ফিরছে বাস নিয়ে। ক্লান্তি, নেশার ঘোর, সব মিলিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে সবাই। জেমস হঠাত এক প্রত্যন্ত গ্রামের ক্ষেতের মাঝে থামাতে বলে বাস। হাঁটতে থাকে। এটা সুন্দরমের গ্রাম। মনে হয় জেমসের কতদিনের চেনা। সুন্দরমের বাড়িতে এসে থামে। গরুটাকে খড় দেয়, বাড়ির লোক খড় পর্যাপ্ত দেয়নি বলে গজগজ করে। মাল্যালি-দের সাদা মুন্ডু (ধুতি) ছেড়ে পরে ফেলে বাইরে টাঙানো তামিল লুঙ্গী। বাড়িতে ঢুকে আসে। সুন্দরমের অন্ধ মা, যিনি সারাদিন একটা থামে হেলান দিয়ে একটার পর একটা তামিল সিনেমা দেখে(শুনে) চলেন, তাকে অদ্ভুতভাবে দেখা যায় জেমসের সাথে অনায়াসে কথাবার্তা বলতে, যেন ছেলে সুন্দরম, দুপুরে, দুবছর আগের অন্য যে কোনো দিনের মতোই বাড়ি ফিরে এসেছে। জেমস রান্নাঘরে ঢুকে আসে সুন্দরমের স্ত্রী এর ঘরের মধ্যে দিয়ে, কফি বানাতে গিয়ে রান্নাঘরের জিনিস কম হয়ে আসা নিয়ে অনুযোগ করে স্ত্রীকে, ওই অনায়াস ভঙ্গীতেই, যেন অবিকল সুন্দরম। সুন্দরমের স্ত্রী আর বাবা হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন, বারণ করতে পারেন না। আর সুন্দরমের মা আর জেমস তো সর্বক্ষণ একে অন্যের সাথে চূড়ান্ত স্বাভাবিক। জেমস সুন্দরমের বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ক্ষেতের দিকে। বাবা-হারা সুন্দরমের মেয়ে বাড়ি ফিরে মা'কে আর বাড়ির সবাইকে বকাবকি করে। সুন্দরমের ভাই, দাদা হারিয়ে যাওয়ার পরে পরিবারের দায়িত্ব নেওয়া ভাই, হয়তো আরো বড় দায়িত্ব নেবে শিগগিরই, সম্ভবতঃ দূরে কোথাও সেইদিন, ফোনে রাগ দেখায় এক প্রতারককে ঘরে ঢুকে এতকিছু করার সুযোগ দেওয়ার জন্য।
শুরু হয় এক লড়াই। জেমসের দলের লোকজন, তার স্ত্রী পুত্র শ্বশুর মিলিয়ে জেমসের এই পরিবর্তন দেখে হতবাক হয়ে যায়। সামনাসামনি দেখা হলে, যা অনেকের সাথেই অনেকবার হয়, জেমস প্রত্যেককে চিনতে অস্বীকার করে। দলের লোকজন এমনকি ভাবতে থাকে পরেরদিন ঘুমের ওষুধ দিয়ে জেমসকে তুলে নিয়ে যাওয়ার কথাও। গ্রামের লোকেরাও সমস্ত ঘটনাপ্রবাহে হতবাক। রাত্রের মতো থাকার জায়গা আর খাবার এর জোগাড় করে দেয় বাসের লোকজনকে। কিন্তু গ্রামের লোক বা সুন্দরমের বাড়ির লোক কোনোভাবেই জোর করে দূরে সরিয়ে দিতে পারেনা দুবছর বাদে জেমস-এর শরীরে বাড়ি ফিরে আসা সুন্দরমের ভাবনাটাকে। বিশেষতঃ সুন্দরমের স্ত্রী ও বাবা তো নিজেদের পুরোনো রুটিনে পরম মমতায় জায়গা দিতে থাকেন জেমস অথবা সুন্দরমকে।
গল্পের পূর্ণাঙ্গ বয়ান যেকোনো সিনেমার আলোচনায় ক্ষতিকারক। একজন লোকও যদি সেই আলোচনা পড়ে ছবি দেখতে যান, তবে ছবির টানটান ভাবটা, ছবির নিজের খেয়ালে গল্পের খোলস ছাড়ানোর আনন্দটা চলে যায় তাতে। তাই এইটুকুই রইল গল্পের। পরাবাস্তব যদি আপনার পছন্দ না হয়, সিনেমার শেষে যদি শুধু একটাই সিদ্ধান্ত নিতে পছন্দ আপনার, দেখবেন না এই ছবি। রজারএবার্টডটকম এই ছবিকে তাদের সর্বোচ্চ রেটিং এর একটা দিয়েছে, ফেলিনি-কে টেনে এনেছে দৃশ্যকল্প'র তুলনায়, ভারতীয় হিসেবে গর্ব হবে কিনা ভেবে দেখা আপনার কাজ।
সিনেমার আত্মাটা কিন্তু লিজো'র রাখা ক্যামেরার মতোই স্ট্যাটিক। লংশটের ব্যবধানে রাখা আপনার থেকে। আপনার জীবনের মতোই তার ব্যাকগ্রাউন্ড-এ প্রচুর সিনেমা আর গান-এর, অর্থাৎ দুনিয়ার বিভিন্ন মায়া'র আওয়াজ ভেসে আসা। সিনেমার মায়া, সুন্দরমের গ্রামের এক দুপুর থেকে পরের দিনের দুপুরের মায়া, এতো মায়ার খেলা আপনাকে নিয়ে যেতেই পারে নিজের অস্তিত্বর মায়াকে নিয়ে প্রশ্ন করবার অবস্থায়। শেষ শটে পুরোনো তামিল সিনেমার অতিনাটকীয় গানের লিরিকে প্রশ্ন ওঠে, শেষ দিনে স্ত্রী রাস্তা অব্দি আপনাকে সঙ্গ দেবেন, ছেলে চিতা অব্দি, কিন্তু অখণ্ডে মিশে যাওয়া পর্যন্ত কে ধরবে হাত? পরিচালকের মর্জি অনুযায়ী'ই আপনার ভাবনাও জেমস ও সুন্দরম এবং তাদের পরিবারের সাথে ভাবনায় ব্যস্ত থাকে, কারণ সবাই এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছে সিনেমার পর্দায় বা তাদের জীবনের একটা দিনে।
No comments:
Post a Comment