Wednesday, February 10, 2010

আমার নামে দু-একটা কথা যা আমি জানি


ক্লাসে ঢুকে হঠাত শুনলাম এক সহপাঠিনী’র গলা ভেসে আসছে প্রথম বেঞ্চের সম্পূর্ণ মহিলা পরিবেষ্টিত জটলা’র মধ্য থেকে। যে লাইনটা তীব্র ভাবে কানে এসে বিঁধল সেটা এইরকম “বুড়ো হয়েছে, মদ খায়, গাঁজা-টাঁজা-ও খায়, তার আবার বড়ো বড়ো কথা”। মনে হল এ তো আমি ছাড়া আর কেউ হতে পারে না, ইনস্টিটিউটের এম বি এ’র সেকেণ্ড ইয়ারে এরকম একটা মারাত্মক বাক্যের সাথে ভয়ংকর বেশী রকমের ত্রহ্যস্পর্শ-মিল যুক্ত ছেলে আমার থেকে যোগ্য কেউ হতে পারে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সরাসরি জিজ্ঞাসা করতে লজ্জিত মুখে সহপাঠিনী জানালেন যে তার লক্ষ্য এ-ক্ষেত্রে আমি নাকি মোটেই নই। সন্দেহ রয়ে গেল মনে, তবে মেনে নিতে হল। তবে বাকি কথা শর্তসাপেক্ষে মেনে নিলেও, ‘বড়ো বড়ো কথা’র বিশেষণে আমাকে ভূষিত করা যায় কি না সে ব্যাপারে আমার নিজস্ব আপত্তিও রয়েছে। আমার “তার-সহ্য’র-সীমা-অতিক্রম-না-করলে-হতে-পারে-জীবনসঙ্গিনী”র কথা’য় বিশ্বাস রাখলে বড়ো বড়ো কথা তো দূরস্থান, আমার নাকি ‘সভ্যসমাজে বিবাহযোগ্য কোন পুরুষ’-যোগ্য বাচন-ক্ষমতা’র সীমাহীন অভাব। কোনো তারল্য-ময় মেহফিল্‌’এ তরলতর দশা’য় হৃদয়ের দু-কূল ছাপানো আবেগে’র বশে কখনো মুখ খুললে আমার সতীর্থদের আওয়াজ শুনি, “আবার বাজে কথা শুরু হলো”। কিন্তু সেই বাজে কথা কখোনো “বড়ো বড়ো কথা”র শ্রেণীভুক্ত নয় সে কথা আমি হলফ করে বলতে পারি। যাই হোক, উপরোক্ত ঘটনা হঠাত করে আমাকে ভাবিয়ে তুলল আমার পেছনে আমার চরিত্র চিত্রণ কেমন হতে পারে তা নিয়ে। ছোট্টোবেলায় আমার আত্মীয়স্বজন’রা আমার অনুপস্থিতি’তে আলোচনা করতেন “এ ছোঁড়া সারা বছর হেগে ভুগে একাকার, বাঁচলে হয়”। পাড়া’য় প্রতিবেশী’রা একমত ছিলেন “বাপের হাতে এরকম মার খেয়ে খেয়ে এ ব্যাটা মরবে একদিন”। বলে রাখি, আমার বাবা এবং তার একটা কালো লাঠি, এই দুটো’র মারাত্মক যোগফল-কে আমি এবং আমার বাড়ির ৫০ মিটার ব্যাসার্ধর প্রতিটি বালক বালিকা ভয় পেতো। প্রাইমারী স্কুলের রেভারেন্ড ফাদার জোসেফ সম্ভবত বলতেন “হে ঈশ্বর, যে অকালকুষ্মান্ড তোমার চার্চের জানলার কাঁচ ক্রিকেট খেলে ভাঙ্গে তুমি তাকে অন্ততঃ ক্ষমা করো না”। আমার তবলার শিক্ষক প্রভাস ‘ওঝা’ তার ২ বছর অক্লান্ত এবং অফলপ্রসূ প্রচেষ্টার পরে জবাব দিয়েছিলেন বোধহয় এই বলে “এর থেকে সাপ নাচানো ঢের সহজ”। আমার প্রথম আঁকার শিক্ষক রবীন-বাবু পাগল হয়ে যান, এবং তার পরে যিনি আসেন সেই তুষার-বাবু ৫০ বছর বয়সে বিবাহ করেন। অর্থাৎ ইতিহাস বলে, তিনিও পাগল হয়েই গেছিলেন। এই সবকিছুর পেছনেই আমার অংকন প্রতিভা’র মারাত্মক হাত আছে বলে আজো আমার সন্দেহ হয়। কলেজিয়েট স্কুলের মারাত্মক মারকুটে বাংলা’র শিক্ষক রাম প্রধান ক্লাসে আমাকে না দেখতে পেলেই বলতেন “বেঁটে-টা নির্ঘাত বেঞ্চের তলায় ঢুকে আছে, বেরিয়ে আয়!!!”। ভদ্রলোক নিজে ৪’১০’’ উচ্চতার ছিলেন, তাই ক্লাসের সেইসময়ের সবথেকে ছোটো-সাইজের আমাকে অত্যাচার করে বেশ নারকীয় আনন্দ পেতেন। আমার ইংরিজি’র গৃহশিক্ষক জলধি-বাবু আমার অনুপস্থিতি-তে খুশি হয়ে বলতেন “Empty vessel – টা আজ আসেনি”। আমার বাজে কথা বলার অসম্ভব ক্ষমতা দেখে তিনি আমি আমার সঙ্গে অত্যধিক আওয়াজ নির্গমনকারী কলসী’র মিল খুঁজে পেয়েছিলেন। তবে সত্যি কথা বলতে তার রাগ ছিল অন্য জায়গায়। তার সুন্দরী মেয়ের পেছনে যারা হস্তপ্রক্ষালন করে সারিবদ্ধ হয়েছিল, তিনি আমাকে সেই সমিতির পান্ডা বলে মনে করতেন। অবশেষে আসল আসামী’কে পাকড়াও করার পর তার সেই অহেতুক রাগ অনেকটা কমে গেছিলো। কলেজ জীবনে বেশ কাছের বান্ধবীরা পেছনে বলত “এই গোঁয়ার গাঁইয়া ঠ্যাঁটা ছেলেটার ভাগ্যে কে জুটবে ভেবে কষ্ট হয়”। আজ গর্বের সাথে বলতে পারি আমি তাদের কথা ভেবে আজ অবধি কাউকে কষ্ট দিইনি। যিনি আমার অনুরোধে আমায় বিবাহ করবার গুরুদায়িত্ব নিতে রাজী হয়েছেন তিনি আমার গুণগুলোর সাথে ভীষন ভাবে পূর্বপরিচিত, তাই তার কষ্ট হচ্ছে যেনেও সে দায় মানতে আমি অপারগ। কলেজ ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক গৌরীশংকর আড়ালে বলত “নামেই প্রেসিডেন্ট, কাজের বেলা’য় ঢুঁ ঢুঁ, কেবল বোতলের ভাগাভাগি’র সময়’ই দেখতে পাই”। রুমমেট’রা ৪ বছর একসাথে কাটানোর পরেও অনুযোগ করত “টুম্পা-টা টুম্পা-ই রয়ে গেলো”।

এইভাবে এতবছর কাটানোর পরেও বুঝতে পারলাম একিভাবে এখনও জানতে ইচ্ছা করে এখনকার মন্তব্য-গুলো কিরকম আমি কতটা আমি রয়ে গেছি জানতে লোভ হয় এখনও কান আর মন খোলা রেখে অপেক্ষায় থাকি আজও, নিজেকে চেনার জন্য

No comments:

Post a Comment