যুদ্ধোত্তর জার্মানি। পশ্চিম। ব্রুনো। পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির সীমানা অঞ্চলে ভেঙে পড়া, বেশিরভাগ সময় জনবিরল, সিনেমাহল সিনেমাহলে প্রজেকশন যন্ত্র সারাই ও রক্ষণাবেক্ষণ করে বেড়ায়। একটা বড় ক্যারাভ্যান। তাতেই থাকা, শোয়া, খাওয়া, গান শোনা। তাতেই ঠাসা প্রজেকশন যন্ত্রপাতি ও তার সারানোর সাজ-সরঞ্জাম।
রবার্ট। জোরে গাড়ি চালিয়ে এসে ব্রুনোর দাঁড়িয়ে থাকা ক্যারাভ্যান-এর সামনের নদীতে এসে ডুবে যাওয়া গাড়ির চালক। আত্মহত্যার চেষ্টা? বড্ড ফাঁপা আয়োজন যদিও। রবার্ট নিজেকে ডাক্তার বলে দাবি করে, জানায় সদ্য ডিভোর্স-এর মানসিক দ্বন্দ্ব-তেই এই আত্মহননেচ্ছা। জামাকাপড় শুকিয়ে নিয়ে ব্রুনোর ক্যারাভ্যান'এই বেরিয়ে পড়া। উদ্দেশ্যহীন। রবার্ট এর জন্য তো বটেই। ব্রুনোর কাজ? সেও তো কতটা সিনেমার ভালোবাসা আর কতটা জীবনযাত্রার খাতিরে তা তর্কসাপেক্ষ।
কথা কম হয়। রাস্তা কাটে বেশি। বোঝার চেষ্টা একে অপরকে? সেরকম দরকারি নয় দুজনার কাছেই। লড়াই, বিরক্তিও আসে। কিন্তু দুজন হাত বাড়িয়ে শূন্যতার আগে একে অপরকেই পায়, তাই সহ্যও করে নেয়।
আমেরিকান সৈন্যদের ছেড়ে যাওয়া ধূসর যৌনতাধিক্যময় সংস্কৃতি ও সেই আশ্রিত সিনেমা, সেই সিনেমাকে ঘিরে থেকে যাওয়া কিছু অনিচ্ছুক, নির্বোধ রোমান্টিক, পরিস্থিতির যাঁতাকলে পড়া মানুষের দেখা পেতে থাকে ব্রুনো। ব্রুনোর আর বিভিন্ন সিনেমাওয়ালার কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে পরিচালক উইম ওয়েন্ডার সিনেমার ক্ষয়িষ্ণু দর্শনকে এই ভাবেই কুটিকুটি করে হাওয়ায় উড়িয়ে দেন। খারাপ লাগে? নিয়তি কেন বাধ্যতে। বর্তমান সময়ের সাথেও মিল? বড় আর্টিস্ট'রা তো ভবিষ্যৎ-দ্রষ্টা হয়েই থাকেন।
সিনেমা এগিয়ে চলতে থাকলে বোঝা যায় চরিত্রদুটি ওই ভেঙে পড়া অতীতগৌরবের সিনেমার মতই ভাঙা আর ফেলে আসা অনেককিছু বয়ে নিয়ে চলেছে। ব্রুনো ফেলে এসেছে নিজের একাকীত্বের শৈশব। রবার্ট ফেলে এসেছে প্যাট্রিয়ার্ক বাবা ও তাঁর প্রযুক্তির গতির কাছে হেরে যাওয়া প্রাণাধিক প্রিয় প্রিন্টিং প্রেস, নিজের ভাঙা বৈবাহিক সম্পর্ক। দুজনেই দুজনের কেবলমাত্র প্রেজেন্সের সাহসে ভর দিয়ে ঘুরে আসে সেই ফেলে আসা ভয়কে বা স্মৃতিকে। বোঝা যায় দুই-পুরুষ-চরিত্রপ্রধান এই ছবিতে নারী, নারীসঙ্গ, নারী-সম্পর্ক'র অশরীরী ছায়ার অস্তিত্ব। চরিত্রদুটিও বোঝে তাদের পালিয়ে যাওয়ার আর পুরনো ভয় বয়ে চলার মানসিকতার পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তার কথা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা থেকে বেরোতে পারে? না শেষ দৃশ্য ইঙ্গিত দেয় তারা তাদের নিয়তির ও সামগ্রিক মানবচরিত্রের এই ফেলে আসা স্মৃতির মৃতদেহ বয়ে চলার দুর্বলতাকে হয়তো কখনোই ছেড়ে আসতে পারবে না।
উইম ওয়েন্ডার। স্বর্গভ্রষ্ট মর্তবাসী এক সহানুভূতিশীল দেবদুতের আশ্চর্য গল্প নিয়ে প্রথম এসেছিলেন আমার কাছে তার 'উইংস অফ ডিজায়ার'-এ। অনেকদিন আগে। এরপর, সামান্য কিছুদিন আগেই, মুখে এসে ঝাপটা মারে তার 'পারফেক্ট ডেজ'। টোকিও'র হিরায়মা আমার দাবিয়ে রাখা একাকীত্বের লোভটাকে উস্কে দিয়ে যাওয়ার পর দেখে ফেলি 'প্যারিস, টেক্সাস'। এরপর এই 'কিংস অফ দ্য রোড'এ আবার ওয়েন্ডার এর কাছে ফিরে যাওয়া। আসলে এ ফিরে যাওয়া নিজের কাছেই। নিজের ভুলগুলো বা নিজের বয়ে বেড়ানো দুঃস্বপ্ন গুলোর কাছেও।