কাকতালীয়ভাবে, যেদিন রুশদিকে প্রায় বিশ-বার ফালাফালা করছে ধর্মের ছুরি, সেদিনই, স্টোরিটেল য়্যাপে সাড়ে বাইশ ঘন্টার অডিওবুক ম্যারাথনে শেষ হলো 'গোরা'। জীবনে দ্বিতীয়বার।
একটু বিষয় থেকে সরে যাই। সম্প্রতি, দি ওয়ার্স্ট পার্সন ইন দি ওয়ার্ল্ড নামক একটা নরউইজিয়ান ছবিতে খুব সুন্দর করে বর্তমান পৃথিবীর চল্লিশের ঘরের ও কুড়ির ঘরের লোকেদের প্রাথমিক ডিলেমাটা বলা হয়েছে। প্রথমটা এখানে প্রাসঙ্গিক। চল্লিশের ঘরের যখন লোকজন একটা নতুন পৃথিবীতে বেড়ে উঠেছিলো, তখন কোনো একটা বিশেষ সামাজিক বা রাজনৈতিক বোধকে কোনো বিশেষ বিশেষ লেখক, শিল্পী, বই, সিনেমা বা মুভমেন্ট দিয়ে সন্তর্পণে খাইয়ে দেওয়া হয়েছিলো। যেটার ভালো আর খারাপ দুটো দিকই ছিলো, কিন্তু একটা কথা একেবারে খাঁটি, তাদের বৈচিত্র্যর বা বিপরীতের সঙ্গে একসাথে বেড়ে ওঠার ক্ষমতা থেকে অনেকটা দূরে সরিয়ে দিয়েছিলো, যার ফল আজকের সময়ে এসে তাদেরকে ভুগতে হচ্ছে।
জীবনে প্রথমবার 'গোরা', 'চার অধ্যায়' আর 'ঘরে বাইরে' পড়া - আমার ব্যক্তিগত রাজনৈতিক আর ধর্মীয় অস্তিত্বটা গড়ে তুলেছিল, যা আজ অব্দি একটুও টসকায় নি, শুধুমাত্র বহিরজগৎ এর চরম বৈপরীত্য সহ্য করতে না পেরে মৌনতা অবলম্বন করতে বাধ্য করেছে।
এই দ্বিতীয়বার এর গোরাপঠন (বা, শ্রবণ) সেই বোধটাকে দৃঢ়ই করলো আরো। এখানেই বাংলার প্রিয় শোকেস-বন্দী ঠাকুরের জয়। সমসাময়িকতা। হতে পারে সাকুল্যে কুড়িটি কবিতা, বাজারচলতি পঞ্চাশটি গান, ব্যক্তিপূজা, বা ব্যক্তিচরিত্রের কালিমালেপনের বাইরে তাকে চিনতে পারার পরিসর কমেই এসেছে, কিন্তু তিনি থাকবেন, অল্প কিছু লোকের মধ্যে হলেও, আবিষ্কার ও পুনরাবিষ্কার এর মধ্য দিয়ে।
প্রাচীন ধর্ম প্রাসঙ্গিক, কিন্তু তার পচন থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখা মূর্খতা। পরিবর্তন প্রাসঙ্গিক, কিন্তু পরিবর্তন এর ঝান্ডা ধরে মূল ও দ্বন্দ্বকে অস্বীকার করা অন্যায়। ধর্মের মোড়লদের দূরে সরিয়ে রাখা কতটা জরুরি, ঠিক যতটা জরুরি ধর্মের দর্শনটাকে নিজের মনের গবেষনাগারে পরীক্ষা করে নির্যাসটুকু তুলে নেওয়া। দুর্বল ও অবহেলিতদের পাশে দাঁড়ানো ততটাই জরুরি, ঠিক যতটা জরুরি ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে তাদের বদলে যাবার পর তাদের উত্তরণের ইতিহাসকে মনে করিয়ে দেওয়া। সমাজপরিবর্তনের ঠিকাদারদের নির্বোধ ভক্তরা ঠিক কতটা অপাংক্তেয়। সবথেকে বড় সত্য হলো আপেক্ষিকতা, আর সত্য নিজে। তাদের পাওয়ার একমাত্র রাস্তা হলো আত্মপর্যালোচনা। গোরা আবার শেখালো। এবং শিখিয়েও মনে করিয়ে দিলো এগুলোই ধ্রুবসত্য বলে দাগিয়ে রাখবার কোনো উপায় নেই, কালের কষ্টিপাথরে যাচাই করে যেতে হবে, প্রতিনিয়ত।
উপন্যাস হিসেবে? মন্তব্য করবার উপায় নেই। পড়াশোনার পরিধি সেই অবকাশ দেয় না। বঙ্কিমগদ্যভাষাকে তরল করে ফেলে এর জোর ও স্বাতন্ত্র্যকে খর্ব করার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন ঔপন্যাসিক বিভিন্ন সময়ে (আমি যাদের শুনেছি - নবারুণ, সন্দীপন)। কিন্তু সে আলোচনা সাজবে তাদের যারা প্রতিনিয়ত এই তুলনামূলক সাহিত্যবিচারে মগ্ন আছেন।