Sunday, August 14, 2022

গোরা

কাকতালীয়ভাবে, যেদিন রুশদিকে প্রায় বিশ-বার ফালাফালা করছে ধর্মের ছুরি, সেদিনই, স্টোরিটেল য়্যাপে সাড়ে বাইশ ঘন্টার অডিওবুক ম্যারাথনে শেষ হলো 'গোরা'। জীবনে দ্বিতীয়বার। 

একটু বিষয় থেকে সরে যাই। সম্প্রতি, দি ওয়ার্স্ট পার্সন ইন দি ওয়ার্ল্ড নামক একটা নরউইজিয়ান ছবিতে খুব সুন্দর করে বর্তমান পৃথিবীর চল্লিশের ঘরের ও কুড়ির ঘরের লোকেদের প্রাথমিক ডিলেমাটা বলা হয়েছে। প্রথমটা এখানে প্রাসঙ্গিক। চল্লিশের ঘরের যখন লোকজন একটা নতুন পৃথিবীতে বেড়ে উঠেছিলো, তখন কোনো একটা বিশেষ সামাজিক বা রাজনৈতিক বোধকে কোনো বিশেষ বিশেষ লেখক, শিল্পী, বই, সিনেমা বা মুভমেন্ট দিয়ে সন্তর্পণে খাইয়ে দেওয়া হয়েছিলো। যেটার ভালো আর খারাপ দুটো দিকই ছিলো, কিন্তু একটা কথা একেবারে খাঁটি, তাদের বৈচিত্র্যর বা বিপরীতের সঙ্গে একসাথে বেড়ে ওঠার ক্ষমতা থেকে অনেকটা দূরে সরিয়ে দিয়েছিলো, যার ফল আজকের সময়ে এসে তাদেরকে ভুগতে হচ্ছে।

জীবনে প্রথমবার 'গোরা', 'চার অধ্যায়' আর 'ঘরে বাইরে' পড়া - আমার ব্যক্তিগত রাজনৈতিক আর ধর্মীয় অস্তিত্বটা গড়ে তুলেছিল, যা আজ অব্দি একটুও টসকায় নি, শুধুমাত্র বহিরজগৎ এর চরম বৈপরীত্য সহ্য করতে না পেরে মৌনতা অবলম্বন করতে বাধ্য করেছে।

এই দ্বিতীয়বার এর গোরাপঠন (বা, শ্রবণ) সেই বোধটাকে দৃঢ়ই করলো আরো। এখানেই বাংলার প্রিয় শোকেস-বন্দী ঠাকুরের জয়। সমসাময়িকতা। হতে পারে সাকুল্যে কুড়িটি কবিতা, বাজারচলতি পঞ্চাশটি গান, ব্যক্তিপূজা, বা ব্যক্তিচরিত্রের কালিমালেপনের বাইরে তাকে চিনতে পারার পরিসর কমেই এসেছে, কিন্তু তিনি থাকবেন, অল্প কিছু লোকের মধ্যে হলেও, আবিষ্কার ও পুনরাবিষ্কার এর মধ্য দিয়ে।

প্রাচীন ধর্ম প্রাসঙ্গিক, কিন্তু তার পচন থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখা মূর্খতা। পরিবর্তন প্রাসঙ্গিক, কিন্তু পরিবর্তন এর ঝান্ডা ধরে মূল ও দ্বন্দ্বকে অস্বীকার করা অন্যায়। ধর্মের মোড়লদের দূরে সরিয়ে রাখা কতটা জরুরি, ঠিক যতটা জরুরি ধর্মের দর্শনটাকে নিজের মনের গবেষনাগারে পরীক্ষা করে নির্যাসটুকু তুলে নেওয়া। দুর্বল ও অবহেলিতদের পাশে দাঁড়ানো ততটাই জরুরি, ঠিক যতটা জরুরি ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে তাদের বদলে যাবার পর তাদের উত্তরণের ইতিহাসকে মনে করিয়ে দেওয়া। সমাজপরিবর্তনের ঠিকাদারদের নির্বোধ ভক্তরা ঠিক কতটা অপাংক্তেয়। সবথেকে বড় সত্য হলো আপেক্ষিকতা, আর সত্য নিজে। তাদের পাওয়ার একমাত্র রাস্তা হলো আত্মপর্যালোচনা। গোরা আবার শেখালো। এবং শিখিয়েও মনে করিয়ে দিলো এগুলোই ধ্রুবসত্য বলে দাগিয়ে রাখবার কোনো উপায় নেই, কালের কষ্টিপাথরে যাচাই করে যেতে হবে, প্রতিনিয়ত।

উপন্যাস হিসেবে? মন্তব্য করবার উপায় নেই। পড়াশোনার পরিধি সেই অবকাশ দেয় না। বঙ্কিমগদ্যভাষাকে তরল করে ফেলে এর জোর ও স্বাতন্ত্র্যকে খর্ব করার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন ঔপন্যাসিক বিভিন্ন সময়ে (আমি যাদের শুনেছি - নবারুণ, সন্দীপন)। কিন্তু সে আলোচনা সাজবে তাদের যারা প্রতিনিয়ত এই তুলনামূলক সাহিত্যবিচারে মগ্ন আছেন।

Tuesday, June 14, 2022

আত্মঘাতী বাঙালি


আমরা যারা ছোটবেলায় মফস্বল থেকে কৈশোরান্তে বিভিন্ন পরীক্ষা-টরীক্ষা দিতে রবিবার ভোরের ট্রেন ধরে সকাল আটটার মধ্যে হাওড়ায় এসে নামতাম, তাদের কাছে দ্বিতীয় লক্ষ্য হতো সকাল দশটা বা এগারোটার মধ্যে কলকাতার নির্দিষ্ট পরীক্ষাকেন্দ্রে উপস্থিত হওয়া। আগে থেকে বাবা-কাকাদের পরামর্শ না নেওয়া থাকলে, ট্রেনে যে সব কাকুরা ডেলিপ্যাসেঞ্জারি করতেন, আনন্দবাজার 'কিনে' পড়তেন, মোটা কালো ফ্রেমের চশমা পরতেন, চেককাটা জামা ইন করে পরতেন না, তাদেরকে জিজ্ঞাসা করতে হতো প্রথম কোন বাসটা ধরে গন্তব্যর সবচেয়ে কাছাকাছি পৌঁছাতে পারবো। যে কোনো কাউকেই জিজ্ঞাসা করা যেতো, কিন্তু এদের এফেক্টিভনেস ছিলো অনবদ্য। একটা "এহ, পোলাপান" গোছের নজর দিয়ে নিজের জ্ঞান কম থাকলেও নিজের ডেলিপ্যাসেঞ্জারি  ব্যাটালিয়নকে দিয়ে টিমওয়ার্ক করিয়ে কোন সাবওয়ে দিয়ে বেরিয়ে সরকারি লাল বা ধুসরবাস বা বেসরকারি নীলবাস ধরতে হবে জানিয়ে তাদের গতি, ভাড়া, এবং গন্তব্যস্থলের য়্যাকিউরেসির ওপর একটা কম্পারেটিভ স্টাডি ঝপ করে ফেলে দিতে পারতেন। অথবা, "এই দাসবাবু, একে আপনার রুটে ঝাঁপতলা পেরলে যে স্টপেজটায় ঘোষের শ্বশুরবাড়ি ছিলো ওটায় নামিয়ে দেবেন তো" মার্কা জ্যাকপট অফার-ও থাকতো কখনোসখনো।


স্টপেজ এ নেমে উদ্দেশ্য থাকতো শেষ লক্ষ্যভেদ। বেশিরভাগ পরীক্ষাকেন্দ্রই হতো উত্তর, মধ্য, বা সদ্য দক্ষিণ কলকাতা শুরু হওয়া এলাকা ঘেঁষা স্কুলে। এবং খুব কম বাসের রুট হাওড়া থেকে সরাসরি পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছে দিতে পারতো। এক্ষেত্রে, এই দ্বিতীয় খেপে, মসিহার ভূমিকায় নামতেন যে সমস্ত পাড়ার কাকুরা, তারা রবিবার সকালে পরনে পরতেন নীল বা বাদামি চেক লুঙ্গি, গায়ে ফতুয়া বা একটা পাতলা সুতির শার্ট, ওপরের দুটো বোতাম খোলা থাকতো, বাঁ কব্জিতে একটা এইচ এম টি'র ঘড়ি, পায়ে চপ্পল, ডানহাতে বাজারের একাধিক বিভিন্ন বহরের ব্যাগ, আর ডানহাতে রোল করে পাকানো য়্যাটলিস্ট দুখানা সংবাদপত্র। সংখ্যাতত্ত্বের বিচারে, সেসময়, শারজায় পাকিস্তানের কাছে ভারতের হারার স্পেকুলেশনের থেকেও সফলতার বেশি সম্ভাব্যতা থাকতো এই সমস্ত কাকুদের পাখিপড়া করে বোঝানো রুটের হদিশে। মনে করিয়ে দেওয়া ভালো, এরা দুটি রুট বলতেন, একটি হতো অন্য একটা বাসে করে শেষ গন্তব্যে যাওয়ার, অপরটি, পায়ে হেঁটে, কিন্তু শর্টকাট। যদিও তাঁদের চোখে লেগে থাকা "তোমাদের বয়সে" চাওনি পরিষ্কার বুঝিয়ে দিতো অপশন যতই দুটো দিন না কেনো, আমাদের হাঁটা-টাই তারা প্রেফার করবেন। 


আমরা কলকাতা এরকম করে চিনেছি। ধীরে ধীরে। নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে না হলেও, বছর ষোলো ধরে। কলেজস্ট্রিট এর পুরনো বই, উত্তর কলকাতার গলি থেকে লঞ্চঘাট, চাঁদনীর সস্তা ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম, লেনিন সরণির পুরনো গ্রামোফোন রেকর্ড, ধর্মতলার নিষিদ্ধ মাংসের কাবাব পরোটা কম্বো, চাঙওয়ার পর্দাঢাকা কেবিন, খিদিরপুর ফ্যান্সি মার্কেটের লজঝড়ে বিদেশিয়ানা, মেট্রোগলির বিল ছাড়া ক্যামেরা আর শ-ব্রাদার্স এর আদা ছোলা, পার্কস্ট্রিট মিউজিক ওয়ার্ল্ড আর ধর্মতলার সিমফনির ক্যাসেট থেকে সিডিতে উত্তরণ, মেডিক্যালের পাশের ফিনাইলের গন্ধ, ট্রামের টং টং, হলুদ ট্যাক্সির সামান্য বাবুয়ানা, এমব্যাসির সিংগিং বার, রাস্তার সস্তা টাটকা খাবার, সাবার্বানের ট্রেনের টাইমটেবিল, গ্র্যান্ডের ফুটপাথের সস্তা ঘড়ি আর টি-শার্টের শখপুরনে, ম্যাগাজিনের বৈচিত্র্যে, বইমেলার ধুলো, ময়দানি আড্ডা, আর অন্তহীন হেঁটে ঘুরে বেড়ানোয়। আরো অনেক কিছু, হ্যাঁ, তবে, আমাদের মত মফস্বলের পেটে খিদে মুখে লাজ ফুটো পকেট উঠতি কালচারসঙ্গমেচ্ছুরা নন্দন রবীন্দ্রসদন বা য়্যাকাডেমি অব্দি পৌঁছাতে পারতো না বললেই চলে।


নিন্দুকেরা বলে থাকেন, প্রেম এমন একটি ওভাররেটেড কন্ট্রাক্ট রিলেশনশিপ, যার শুরু বাদী এবং বিবাদীপক্ষ করে এমন সব টেকনো-কমার্শিয়াল টার্মস দিয়ে যা দুপক্ষের কাছেই বেশ গ্রহণযোগ্য এবং আয়ত্ত্বের মধ্যে, বাকি কনফ্লিক্ট এর জায়গাগুলো থাকে ভদ্রতার মুখোশে চোরাগোপ্তা লুকিয়ে। কিন্তু বিধাতার অথবা প্রকৃতির রাজ্যের মূলে রয়েছে ডারউইনবাদ, যা বলে যোগ্যতমের লড়ে জিতবার কথা অথবা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বিবর্তন এর কথা। প্রেমিকযুগল প্রকৃতির নিয়মের চেয়ে সহজ টার্ফ-এ খেলতে নেমে লড়াই ভোলেন এবং শিকার হন হ্যালুসিনেশনের। অতএব প্রগাঢ় হয় প্রেম। আসে আরো একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত সত্যিকারের পারস্পেক্টিভ বিন্দুমাত্র বিবেচনা না করে। যথানিয়মে, ভুল ভাঙে, কিন্তু সে মুহূর্তে দু পক্ষই হারিয়েছে লড়ে নিজস্ব ব্যক্তিগত পরিসর তৈরির ক্ষমতা, অতএব পড়ে থাকে সন্দেহ ঘৃণা বিরক্তির মত ঋণাত্মক যুগ্ম কিছু মানসিক বোঝা, সারাজীবন বয়ে বেড়ানোর। কলকাতার সাথে আমার প্রেম সেরকমই ছিলো। বাইরে থেকে মোটা কালো চশমা বা নীল লুঙ্গির দরাজমনা লোকজনের বাইরে আরেকটা দুনিয়া ছিলো চোখেই পড়েনি তা। সেই দুনিয়ার লোকেরা খাঁটি অথচ ওভাররেটেড ভ্রান্ত রাজনীতির হাতে একসময় হারিয়েছে যৌবন। পরবর্তী সময়ে সেই রাজনীতির শাখা প্রশাখায় ঢুকে হারিয়েছে পথ। কেউ শুরুতে ভাগচাষী থেকে জমির মালিকানা হাতে পেয়ে শেষে জমিদার হতে গিয়ে খেয়েছে ঠোক্কর। কেউ চাকরি পেয়েছে, সালাম ঠুকেছে, তারপর আয়নার সামনে নিজের ভিখিরিপনা দেখতে পেয়ে নিজের মুখে থুতু দিয়েছে। কেউ পতাকা ধরে মালিকের শোষণ থেকে বাঁচবার পর কাজ করে নিজের কাজের জায়গাটাকে কাজ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার কর্তব্যটাই বেমালুম ভুলে গেছে। কেউ দু-আনার কলম বা মাইক বা ক্যামেরা ধরে সরকারপক্ষের ও প্রতিষ্ঠানের পিঠচাপড়ানি কুড়িয়েছে ঝুঁকে, কেউ কলম আর শিরদাঁড়া বাঁকাতে চাইনি বলে পড়ে থাকতে বাধ্য হয়েছে তৃতীয় শ্রেণীর শিল্পের অন্ধকার গর্তে পুঞ্জীভূত ঘৃণা বুকে ধরে। শাসকের মুখ বদল হয়েছে কিন্তু শাসনকাঠামোর রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে যাওয়া অহং আর ঔদ্ধত্য মৌরসিপাট্টা গেড়েছে।


হচ্চিলো কথা প্রেমের। আমার ও কলকাতার প্রেম এতটাই জমাট বেঁধেছিলো যে আমি নবরত্ন কোম্পানির বেশ শাঁসালো চাকরি ছেড়ে কলকাতায় একটি তৃতীয় শ্রেণীর বিজনেস স্কুলে পড়বার ঝুঁকি নেই এই ভেবে যে পড়াশোনার শেষে কষ্ট করে হলেও আমার প্রিয়তমা শহরের বুকে থাকবার জায়গা মিলবে। সে লক্ষ্য পূরণ-ও হয়। কিন্তু সে হ্যালুসিনেশন ভাঙতে ছ-বছরের বেশি সময় লাগেনা। মোটামুটি মন, আত্মসম্মান ও আত্মনির্ভরতা-শূন্য হয়ে আমি আমার কলকাতাবাস দ্বিতীয়বার এবং সম্ভবতঃ শেষবার এর মতো সমাপ্ত করি। ইতিমধ্যে শাসক বদল হয়েছে। শাসক নির্বাচিত করবার হাত বা মন যেহেতু বদলায় নি, তাই পরিবর্তন এর নামে একটি অশ্বডিম্ব প্রসব হয়েছে। গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরবার অলীক বিপলব থেকে সংসদীয় সমাজতন্ত্র নামক সোনার পাথরবাটি পেরিয়ে শেষপাতে এসেছেন বিপলবের আসল মা যার চেয়ার মুছতে গিয়ে বেতনভুক অকর্মা লুম্পেন, ভিখারি কবি অথবা সহি অতিবামপন্থী ছেলেরা কখনো ভিজিয়ে ফেলছে চোখ, কখনো কখনো রক্তে মাটি অথবা ঢেকে ফেলছে পোড়া ছাই এ শরীর। সময়ের সাথে সাথে বঙ্গনাট্যশালার অলীক কুনাট্যে বীতশ্রদ্ধ হয়ে মোটামুটি ভদ্রস্থ সন্তানেরা যেহেতু আজ তিরিশ বছর ধরে মাইগ্রেশন করে চলেছে, তার জায়গা নিয়ে চলেছে কোথাও যাবার ক্ষমতা ও গুণ না থাকা পেটি বুর্জোয়ারা। তারাও প্রেমে পড়ছে, কলকাতার, কিন্তু সেটা নিজের উপার্জনক্ষমতার বাইরে দাদা-দিদির ছুঁড়ে দেওয়া পয়সার অনুগ্রহে, কাজে ফাঁকি দেবার মোহে, সরকারি দয়াদক্ষিণ্যের হাতছানিতে। তাই পঞ্চাশবছর বাদেও কিছুতেই নামছে না নেমে আসার গ্রাফ। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত দুনিয়া জুড়ে অতি দক্ষিণপন্থী শক্তির বাড়াবাড়ি এসেছে, মড়ক এসেছে আর ভারতের পুরোনো বহু ক্ষতবিক্ষত ফেব্রিক এ নতুন করে রক্ত নিয়ে হোলি খেলতে নেমে এসেছে সঙ্ঘপরিবার ও তাদের মুখোশ, যাদের হাত প্রতিদিন আরো শক্ত হয়ে চলেছে।


এ সলিলকির সাথে বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই, তবুও ঘাড় ঝুঁকিয়ে মেনে নেবার ও রসাতলে যাবার গল্প যখন হচ্ছে - গত একত্রিশে মে, দুহাজার বাইশে, কলকাতায়, প্রখ্যাত গায়ক কেকে তার অনুষ্ঠান শেষ করে মারা যান। একটি মত বলছে, আড়াই হাজার মানুষের সভাগৃহে ছিলো আট-হাজারী ভিড়, যার দরুণ এসি বিকল হয় অথবা বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং গায়ক শারীরিক অস্বাচ্ছন্দ্য উপেক্ষা করে নিজেকে মৃত্যুর দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে বাধ্য হন। এই একই সর্বভারতীয় গায়ককে, বাংলার আরেক গায়ক ড়ুপঙ্কর (বানানভুল ইচ্ছাকৃত) তার আগেরদিনই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করায় প্রাণঘাতী খাপ বসে, বাঙালি গায়ক জানান তিনি কেবলমাত্র বাংলা গানের পাশে থাকবার কথা বলতে গিয়ে, অর্থাৎ গুনগত মানের কথা না বলে একটি কোটারির ভিক্ষা করতে গিয়ে কাকতালীয়ভাবে ঘটি হারিয়ে ফেলেছেন। মজার কথা হোলো, একটু ভেবে দেখলে, আমার ব্যক্তিগত ধারণা, এই একই অপরাধ দিব্যি সংগঠিত ভাবে সংঘটিত হয়েছে বর্তমান সময়ে কোনোরকম উচ্চবাচ্য  ছাড়াই। সরকার, য়্যাপট্যাক্সিচালক ও য়্যাপট্যাক্সিপারেটররা ত্রিমুখী বোঝাপড়ায় গত দুবছর ধরে শতকের সবথেকে কঠিন সময়ে দ্বিগুণ দরে তোলা আদায় করেছেন, সাধারণ মানুষকে অসহনীয় কষ্ট দিয়েছেন গাড়ির এসি বন্ধ রেখে, লাভ তুলেছেন ও ভোটব্যাংক এবং চাঁদা অক্ষুণ্ন রেখেছেন - আমার ধারণা বেশ কিছু লোক এই চক্করবাজিতে পটল-ও তুলেছেন, নেহাত গায়ক কেকে না হবার কারণে মৃত্যুপরবর্তী প্রচার পাননি এই যা। মোটকথা এই যে 'তোমাকে কাজ করতে দেব না' বা 'তোমার থেকে পয়সা নিয়ে মুখের ওপর বলবো পরিষেবা একটি মিথ অতএব যা পাচ্ছো তাই নিয়ে ঘর বাঁধো', এইটে বেশ হাড়ে মজ্জায় ঢুকে গেছে এই বাংলায়। শেষ দুটো টার্ম এর চন্দনের বাবা ব্যারিস্টার বসু থেকে অনুপ্রেরণাদাত্রী ঝপাংকবি, সবাই এই কালচার আনা, দুধ কলা ক্যাডার দিয়ে তাকে পোষা, ও তার বাড়বৃদ্ধিতে সাহায্য করেছেন এবং শেষমেশ সোনার ভোটের ফসল ঘরে তুলেছেন। মাঝখানে বুদ্ধদেব সামান্য বেগড়বাঁই করতে চেয়েছিলেন ডু-ইট-নাও বা শিল্প-টিল্পর মত অস্পৃশ্য শব্দ উচ্চারণ করে, কিন্তু তার নিজের ও দলের সুখের পায়রা কর্মীদের ঔদ্ধত্য সামলাতে না পেরে সমূলে উৎপাটিত হয়েছেন। 


এই এলোমেলো লেখা শুরু করেছিলাম কলকাতার বুকে একের পর এক হওয়া আত্মহত্যার নিরিখে। মনে হয়েছিল যে বাঙালি গত প্রায় তিরিশবছর ধরে দিব্যি খোশমেজাজে চপমুড়ি বিরিয়ানি প্যাঁদাতে প্যাঁদাতে সামাজিক আত্মহত্যা করে আসছে তার হঠাৎ দু-চারখানা জলজ্যান্ত আত্মহত্যাতে এত দুঃখ উথলে উঠছে কেনো। তারপরে খেয়াল করে দেখলাম ক্লিকবেট খবর দেখে বাঙালির মন বোঝার চেষ্টার বড় ভুল করে ফেলেছি, ব্যাপারটা অতটাও সিরিয়াস নয়। বাজারে যে মাছওলা কেজিতে পঞ্চাশটাকা বেশীতে সবথেকে খারাপ মাছটা বেচে আপনাকে, তার কারণ আপনি তার থেকে নিয়মিত জিনিস নেন - আপনার ব্যাংকের যে রিলেশনশিপ ম্যানেজারটি আপনার দুটো লোন করিয়ে দিয়ে নিজের টার্গেট ছোঁয়ার পর সেই লোন এর ইমোশনাল কুমিরছানা দেখিয়ে আপনাকে দুটো পয়সা জলে দেওয়া স্কিম করতে বাধ্য করে - আপনার বাসের যে কন্ডাক্টরটি সময় বাঁচানোর জন্য প্রায় চলন্ত বাস থেকে শিশু বৃদ্ধ মহিলাদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দেয় - যে বাঙালি ব্যবসায়ীটি আপনার সমস্ত ভরসার জলাঞ্জলি কেবলমাত্র নিজের আলস্য আর লোভের কারণে দিয়ে দিতে পারেন - বাড়ির পাশের যে বাঙালি ড্রাইভারটিকে আপনি দ্বিগুণ পয়সা দিয়ে ব্যবহার করেন ও সে আপনাকে সুযোগ পেলেই কাঁচকলা দেখায় ও বিভিন্ন অজুহাতে পয়সা আদায় করে - তারাও তো আত্মহত্যাই করে চলেছে। নিজের। নিজের পরবর্তী প্রজন্মের। নিজের মাটির। অতএব এ নিয়ে মনখারাপের বিলাসিতা মানায় না। অতএব, হে বাঙালি, আপনারা বাঁচুন, ম্যাক্সিম গোর্কির মাদারের সমতুল্য সারদার থুড়ি সততার প্রতীকের ঘাসফুলগাছের ছায়ায় বাঁচুন, দাঙ্গাবাজেদের হোয়াটসয়্যাপ ফরওয়ার্ডে হিন্দু মৌলবাদী হবার বা সাধারণ মানুষের অসুবিধেকে তুড়ি মেরে ভোটবাজদের সাম্প্রদায়িক তোষনের পাঠ নিতে নিতে বাঁচুন, 'মানুষ ভুল করে বুদ্ধিজীবীদের প্ররোচনায় আমাদের উৎখাত করেছিল, আমরা তো কোনো দোষ করিনি' মার্কা সিপিয়েমিয় ভ্রান্তিতে বাঁচুন। আমার মত কাপুরুষেরা হাল ছাড়ুক, যেমন ছেড়ে চলেছে, বা চলবে।