জায়গাটা আমায় চিনিয়েছিল আমার ভ্রাতৃপ্রতিম সম তরঙ্গদৈর্ঘ্য বিচরণকারী এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ছোটোবেলায় প্রথম যখন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়’এর লেখার সাথে পরিচিত হই, তখন শারদীয় আজকাল’এ “কোলকাতার দিনরাত্রি” বলে একটা উপন্যাস পড়ি। নামেই উপন্যাস। আসলে কল্লোল যুগ-এর মাথা-দের (সুনীল, শক্তি, সন্দীপন) বোহেমিয়ান কোলকাতা-বাসের উদ্দাম দিনলিপি। সেখানেই প্রথম শুনি ‘ছোটা ব্রিস্টল’-এর নাম। আনন্দবাজারের অফিস থেকে ঢিলছোঁড়া দূরত্বে জায়গাটা সে যুগের কোলকাতা’র নামকরা সুরারসিক কবি-সাহিত্যিক-দের মিলনমেলা ছিল। জায়গাটা’র নাম আমাকে খুব খুশি করেছিল। “ছোটা ব্রিস্টল”। বাংলার বুকে হিন্দী’র ছোঁয়ায় ইংরিজী মদের ঠেক। ভেবে রেখেছিলাম বড় হয়ে কখনো না কখনো এই তীর্থস্থানে একবার পা রাখতে হবে। সস্তায় তারল্যর খোঁজে এক দুপুরে আমরা কয়েকজন, আমার সেই বন্ধু’র নেতৃত্বে, স্টেটসম্যান হাউসের পাস দিয়ে, ধর্মতলার মসজিদ আর কাবাবের গন্ধ পেছনে রেখে লেনিন সরনী পেরিয়ে মেট্রোগলির অন্ধকারে পৌঁছালাম “সাহু”তে। ততক্ষণ পর্য্যন্ত্য সেই জায়গাটার নাম “সাহু”ই শুনে আসছিলাম। পৌঁছে দেখলাম আসলে সেটা “The Shaw Brothers’ Wine Pvt Ltd”। লোকমুখে ‘সাহু’। নিউমার্কেটের ধাঁচের আর্কিটেকচার। পুরোনো কোলকাতার গন্ধ। হঠাত করে উপরে চোখ পড়তেই একরাশ য়্যাড্রিনালিন দৌড়াল শরীরে। আরে, এটাই তো সেই আমার সাধের ছোটা ব্রিস্টল। উপরের একটা ছোট্ট বোর্ডে আমার মত পুরোনো স্মৃতি খোঁজা আনাড়ীর স্বার্থেই পুরোনো নামটাও রাখা রয়েছে। দরজা খুলে ঢুকতেই চমক। ঠান্ডা হাওয়া। ধুনোর গন্ধ। কাতারে কাতারে লোক যাদের গড় বয়স ৫৫’র উপরে। পাশে পাশে ঘিঞ্জিভাবে বসে কিন্তু একে আন্যের থেকে মানসিকভাবে চরম দূরত্বে। বাজারের ব্যাগ’এর ফাঁকে উঁকি মারা ফুলকপি, লাউ, ডাঁটা। কারো সাথে পেপার বা হিসেবের খাতা। একই টেবিলে ৬ জন বসে, অথচ কেউ কাউকে চেনে না বা চেনবার চেষ্টা করছে না। বেশীর ভাগ ওয়েটার পক্ক্বকেশ, ষাটোর্ধ্ব। চাট হিসেবে টেবিলে চেনা জিনিসের সাথে পেয়ারা, আলুকাবলি, মেটে-ভাজা, চিঁড়ে এবং সম্ভব অসম্ভব সমস্তকিছু। প্রত্যেকের কাজ শুধুমাত্র মদ খাওয়া, আর কিচ্ছু নয়। ৭০ বছরের বৃদ্ধ ঢুকছেন ঝুঁকে, কাঁপা হাতে শেষ করছেন ৬-৭ পেগ রাম অথবা হুইস্কি, তারপরে বেরিয়ে যাচ্ছেন মাথা উঁচু করে আমাদের লজ্জা দেওয়া সোজা পদক্ষেপে। টয়লেটে দরাজ গলায় হেমন্ত, মান্না, জটিলেশ্বর গাইছেন এক বৃদ্ধ। মোটা গাটাপার্চার ফ্রেমের চশমা-পরা এক বৃদ্ধ আমাদের বয়সী এক বাল্যখিল্য অত্যুতসাহী-কে বকাঝকা করছেন “তুমি মদ খেতে শিখেছ?”। সবমিলিয়ে এককথায় এক মায়াময় পরিবেশ।
এককথায় এই পরিবেশের টানেই বার বার ফিরে গেছি ওখানে। কোলকাতায় আমার প্রিয়তম জায়গার সূচীতে ধর্মতলা-পার্কস্ট্রীটের ফুটপাথের পরেই এই জায়গাকে রাখতে পারি আমি। এবারে কিছু বিশেষ জরুরী বিষয়ঃ
১। বয়স ৪০-এর কম হলে এখানে সামান্য সম্মান-ও আশা না করাই ভালো। তার জায়গায় শুনতে হতে পারে “এরাও আবার মদ খায়!”, “গোলমাল কোরো না, গোলমাল করতে হলে অন্য জায়গায় যাও, এই জায়গার আলাদা ঐতিহ্য আছে”, “২ পেগ খেয়ে টয়লেটে ছোটে, এরা আবার মদ খাবে!!” এরকম সব ভয়ংকর ব্যাঙ্গ। ওয়েটার এবং কাস্টোমার দুজনের কাছ থেকেই।
২। এটা আমার দেখা প্রথম “প্রি-পেড” বার। এখানে ক্রেডিট কার্ড জাতীয় শব্দ উচ্চারণ করাও নিষিদ্ধ।
৩। এটা আমার দেখা প্রথম জায়গা যেখানে কমপ্লিমেনটারী হিসেবে ছোলা, আদা আর নুন দেয়া হয়।
৪। এখানে ওয়েটারেরা ভীষণ রাগী। এরা একবারের বেশী দুবার কিছু বললে, তাড়াতাড়ি কিছু আনতে বললে, এ,সি, চলাকালীন গরম লাগছে বললে, কম খেয়ে উঠে যাবার চেষ্টা করলে, গান করলে, পেপসি মিশিয়ে হুইস্কি খেলে, এবং আরো অনেক কারণে ভীষণ রেগে যান।
৫। এখানে ভীড় অনুযায়ী ঢোকবার ন্যূনতম বয়স স্থির হয়। খুব ভীড় থাকাতে ২৬ বছরের লোক-কেও বের করে দেওয়া হয়েছে এরকম প্রমাণ আছে।
পুনশ্চঃ - আমার কাকা, যিনি আমার বাবার থেকে বছর-দুয়েকের ছোটো, তিনি একজন সুরারসিক। আমি তাকে একদিন উতসাহের আতিশয্যে জানাই আমি একটা অসাধারণ জায়গা আবিষ্কার করেছি যার পরিবেশ অসাধারণ। সঙ্গে সঙ্গে তার চোখে এক শূন্য দৃষ্টি দেখে আমি নিজেকে সংবরণ করি। ভাবি সেই দৃষ্টি আমার অসংযত জীবনকে পরোক্ষ তিরস্কার। কিন্তু এক মুহূর্ত চুপ থাকার পর তিনি বললেন “ছোলা আর আদা তো?”। বুঝলাম সেই শূন্য দৃষ্টি আসলে এক রসিকের স্মৃতি রোমন্থন মাত্র।